রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ

রুহুল ও আতিক কোথায়

সাখাওয়াত কাওসার

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আলোচিত জজ মিয়া এখন জালাল নামেই পরিচিত। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম মো. জালাল আহমেদ। গাড়ি চালানোর  লাইসেন্সেও ব্যবহার করেছেন এই নাম। তবে জজ মিয়া পরিচয় প্রকাশ পেলেই বদল করেন ঠিকানা। জজ মিয়া বলেন, এ নামটি শুনলে এখনো ভয়ে আঁতকে ওঠেন তিনি। অন্যদিকে জজ মিয়ার নাটক সাজিয়ে ঘোষিত পুরস্কারের কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক তিন কর্মকর্তা এখন জামিনে রয়েছেন। গ্রামের সহজ-সরল এক যুবককে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে জজ মিয়া নাটকের জন্ম দিলেও পরবর্তী সময়ে মামলাটি অধিক তদন্তের পর এর রহস্য উন্মোচিত হয়। এদিকে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে জজ মিয়া বলেন, ‘ভাই, “জজ মিয়া” নামটি শুনলেই আমার ভয় লাগে। জজ মিয়া নাম শুনলেই মানুষ আমারে সন্দেহ করে। সকলেই আমারে এড়াইয়া যাইত। মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে করছি। তাও “জালাল” নামে। তবে আপনাগো কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনারা আমারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরাইয়া আনছেন।’ বর্তমানে জজ মিয়া তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকার রায়েরবাগে বসবাস করছেন। আগে সাইনবোর্ড এলাকায় থাকলেও জজ মিয়া নামটি মানুষ জেনে ফেলার কারণে ওই এলাকা ছেড়ে দেন। আগে কেবল মা জোবেদা বেগম ও বোন খোরশেদা আক্তারকে নিয়ে ছিলেন। গেল রমজানের ছয় দিন আগে বিয়ে করেন তিনি। মা, বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখে-দুঃখেই দিন কাটছে তার। রেন্ট-এ-কারে চালক হিসেবে কাজ করেন।

ওই সময়ের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে জজ মিয়া বলেন, ‘ওই দিন (২১ আগস্ট ২০০৪) আমি বাড়িতে বাবুলের চায়ের দোকানে ছিলাম। টেলিভিশনে দেখে এলাকার লোকজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। সেখানে গ্রামের মুরব্বিরা সবাই ছিলেন। কিন্তু সেই আমাকেই কি না বানানো হলো গ্রেনেড হামলাকারী! সেনবাগ থানায় এসপি রশীদ সাব (সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ) ক্রসফায়ারে মারার ভয় দেখিয়ে বলেন, যা শিখিয়ে দিব সেগুলো কোর্টে বলতে হবে। তাই প্রাণভয়ে কোর্টে স্বীকারোক্তি দিই।’

২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর গ্রেনেড হামলাকারীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেন। ২০০৫ সালের ৯ জুন নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় জজ মিয়াকে। এর পর থেকেই শুরু হয় তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তার বিশেষ মহড়া। জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পুরস্কার এক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সিআইডির তৎকালীন তিন কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, এএসপি আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমান। জজ মিয়াকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে সিআইডির তিন কর্মকর্তা স্বীকারোক্তি আদায় করেন ১৬৪ ধারায়। বিনিময়ে তার মাকে প্রতি মাসে সংসার খরচের জন্য দুই হাজার টাকা করে দিতেন রুহুল আমিন, মুন্সি আতিক ও আবদুর রশিদ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জানা যায় প্রকৃত ঘটনা। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া।

বিনা অপরাধে চার বছর জেল খেটে ওলট-পালট হয়ে যায় তার জীবন। নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার বীরকোর্ট গ্রাম থেকে সর্বশেষ ছয় বছর আগে পৈতৃক ভিটা ৭ শতাংশ জমি বিক্রি করে দিয়ে গ্রাম ছাড়েন তিনি। আর গ্রামে ফিরে যাননি। গ্রামের মানুষ তার কোনো ঠিকানাও জানে না। ঢাকায় এসে বেকার জজ মিয়া গাড়িচালকের চাকরি নিয়েছিলেন দেশটিভিতে। অধিক পরিশ্রম ও অল্প বেতনের কারণে সেই চাকরিও ছেড়ে দিয়ে এখন ভাড়ায় গাড়ি চালান।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ বলেন, টাকা লোপাটের ঘটনাটি ঘটে জজ মিয়া নাটকের পর। আসামি গ্রেফতারকারীর জন্যই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই হিসাবে জজ মিয়ার নাটক করে ওই সময়ের কর্মকর্তারা তদন্ত শেষ করেছিলেন। যে কারণে সেই পুরস্কারের টাকা ওঠানোর সুযোগ হয়েছিল তাদের।

গতকাল এ প্রতিবেদককে জজ মিয়া বলেন, ‘ওই সময় আমি মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকায় হকারি করে ফল বিক্রি করতাম। মাঝেমধ্যে স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় পোস্টার বিক্রি করতাম। দুই-তিন মাস পর পর বাড়িতে যেতাম। ২১ আগস্টের সাত-আট মাস পর আমাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রামের চৌকিদার বাড়িতে এসে বলেন, তোমার নামে থানায় মামলা আছে। থানা থেকে কবির দারোগা (ওই সময় সেনবাগ থানার এসআই কবির হোসেন) আসতেছে। তুমি এখানে বসো। এরপর সেনবাগ থানার কবির দারোগা এসে আমাকে হ্যান্ডকাফ লাগান। আমার এলাকার জামাল মেম্বার (ইউপি মেম্বার) কবির দারোগাকে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে? কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি। থানায় নেওয়ার পর কবির দারোগা বলেন, তোমার নামে এখানে কোনো মামলা নাই। ঢাকা থেকে সিআইডির এসপি রশিদ সাব আসতেছেন। ঢাকায় তোমার নামে বড় মামলা আছে। এসপি রশিদ সাব (সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ) আমাকে বলেন, আমরা যা বলি তা-ই হবে। আমারে থানার মধ্যে ব্যাপক মারধর করেন। একপর্যায়ে বলেন, আমাদের কথা না শুনলে তোরে ক্রসফায়ারে দিব। আর কথা শুনলে তোরে বাঁচাইয়া আনব। তোর ফ্যামিলিকে খরচের টাকা দিব। মাইরের চোটে আমার হাতের হাড্ডি ভেঙে যায়। এরপর আমারে নোয়াখালীর সেনবাগ থানা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ক্রসফায়ারে মারার ভয় দেখিয়ে তারা যা শিখিয়ে দেন সেগুলো কোর্টে বলতে বলেন। আমি সেভাবেই বলি।’

সর্বশেষ খবর