রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

অপরাধীরা যখন রাষ্ট্র ক্ষমতার নীতিনির্ধারক

নিজস্ব প্রতিবেদক

একুশে আগস্টের সেই ভয়াল গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই কাজ করেছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ মদদে চালানো হয়েছিল এই জঙ্গি হামলা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষস্থানীয়রা কাজ করেছেন নেপথ্যে। হামলার সঙ্গে জড়িতদের সহায়তা করেছেন রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্ণধাররা। পরিকল্পনার সবই জানতেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা। শুধু হামলা নয়, পরবর্তীতে মামলার আলামত নষ্ট করার প্রক্রিয়াতেও তারা সম্পৃক্ত ছিলেন। মামলার চার্জশিট, অন্যান্য নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২১ আগস্ট যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছে তা সাধারণত পুলিশের হাতে থাকে না। এটা আনা হয়েছিল পাকিস্তান থেকে। অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেডে সেই আলামত পাওয়া যায়। এসব গ্রেনেড বিস্ফোরণ হলে ৩৫ গজের মধ্যে যারা থাকেন তাদেরই মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পুলিশ আগে থেকেই এ বিষয়টি জানত বিধায় তারা ৬০ গজের বাইরে অবস্থান নিয়েছিল। দুর্ভাগ্য হলো, সেদিন এই অপকর্মে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছিল। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, পাকিস্তানের মাজেদ ভাটের কাছ থেকে তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজুল ইসলাম এসব গ্রেনেড নিয়ে আসেন। নিতান্তই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়তো সেদিন শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন।’ সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার টার্গেটে ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আইভি রহমানসহ ২২টি তাজা প্রাণ সেদিন ঝরে গিয়েছিল। হামলা হয়েছিল তৎকালীন সরকারি মদদে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা মদদে না হতো তাহলে হত্যাকাণ্ডের পর আলামত কেন নষ্ট করা হলো? কেন এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হলো না? মার্কিন গোয়েন্দা এফবিআইকে কেন তদন্ত করতে দেওয়া হলো না? বরং সাজানো হলো জজ মিয়া নাটক। এ থেকেই বোঝা যায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য।

মামলার নথিসূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া প্রথম অভিযোগপত্রে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়েছিল। পরে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে নতুন করে ৩০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২০১২ সালে আদালতে জমা দেওয়া অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে সম্পৃক্ত ষড়যন্ত্রকারীদের নাম ও কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স, ডিএমপির তৎকালীন উপকমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান, সাবেক উপকমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, হুজির আমির মাওলানা শেখ ফরিদ, হুজির নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা আবদুর রউফ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইর সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার (বরখাস্ত), হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির (আইডিপি) আহ্বায়ক মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরী জঙ্গি আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, সিআইডির সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ ওরফে পরিবহন হানিফ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, বাবু ওরফে রাতুল বাবু, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন প্রমুখ। আসামি তালিকায় আরও আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, সাবেক এমপি মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রমুখ।

যেভাবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা : ২০০৪ সালে ঘটনার সময় ডিজিএফআইর জঙ্গিবাদ দমনসংক্রান্ত ব্যুরোতে কর্মরত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মিজানুর রহমান। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ডিজিএফআইর তৎকালীন কতিপয় কর্মকর্তা কীভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত হুজি নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, তার বিবরণ দিয়েছেন। এ ছাড়া ডিজিএফআই ও এনএসআইর সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম যে ২১ আগস্টের ঘটনায় জড়িত তা মামলার দ্বিতীয় দফায় জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানও। মুফতি হান্নান তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘২০০৪ সালের আগস্টের শুরুতে সিলেটে গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভার সংবাদ জানতে পারি। সেখানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত হয়। আমি মাওলানা আবু তাহের, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা রশিদসহ আল মারকাজুলের গাড়িতে করে হাওয়া ভবনে যাই। সেখানে হারিছ চৌধুরী, লুত্ফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর আলী আহসান মুজাহিদ, ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিমকেও উপস্থিত পাই। কিছুক্ষণ পর তারেক রহমান আসেন। আমরা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তাদের সহায়তা চাই। তখন তারা আমাদের প্রশাসনিক সকল প্রকার সহায়তার আশ্বাস দেন।’ ২১ আগস্টের হামলার পর ডিজিএফআই তাজউদ্দিনকে ভুয়া পাসপোর্টে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়। পুরো ঘটনার সঙ্গে ডিজিএফআইর কিছু কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও এ বিষয়ে সবাই অবহিত ছিলেন না। ঘটনার পরদিন সংস্থার প্রধান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওই ঘটনার তদন্ত করার অনুমতি চান। বেগম জিয়া তাকে এই বলে নিবৃত করেন যে তার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তদন্তের জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হবে।

হামলাকারীদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন বাবর-তারেক : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশগ্রহণকারীদের হামলার সময় প্রশাসনিক সাহায্য ও নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। এ নিয়ে হাওয়া ভবনে বৈঠক করেন তারা। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন মেজর (অব.) আতিকুর রহমান। সাক্ষ্য গ্রহণ করেন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দীন। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আতিকুর রহমান জানান, তিনি ২০০৪-০৯ পর্যন্ত র‌্যাব সদর দফতরে গোয়েন্দা শাখার উপপরিচালক (ইন্টারোগেশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ওই শাখার পরিচালক ছিলেন কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি বিডিআর বিদ্রোহে নিহত হন। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের ছোট ভাই অভিকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিনই ঢাকার মেরুল বাড্ডা থেকে মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করা হয়। মুফতি হান্নানের গ্রেফতারের বিষয়টি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরকে জানানো হলে তিনি সন্তুষ্ট হননি।

আলামত নষ্ট : সেদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঘটনাস্থলের সব আলামতই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে ফেলা হয়। ঘটনাস্থলে চারটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পাওয়া গিয়েছিল যার দুটি ওই রাতে আর দুটি পরদিন ধ্বংস করে ফেলা হয়। গ্রেনেডের গায়ে অপরাধীদের আঙ্গুলের ছাপ থাকার কথা কিন্তু গ্রেনেড-গুলি ধ্বংস করার সঙ্গে সঙ্গে তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঘটনাটি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ থানায় মামলা করতে গেলে উপরের নির্দেশ না থাকায় মামলা নিতে থানা অস্বীকার করে।

সর্বশেষ খবর