সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বসুন্ধরা শপিংমলে আগুন, নাশকতার আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বসুন্ধরা শপিংমলে আগুন, নাশকতার আশঙ্কা

গতকাল বসুন্ধরা শপিংমলে ছয় তলায় আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর অভিজাত শপিং কমপ্লেক্স বসুন্ধরা সিটির অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা এর সুষ্ঠু তদন্তেরও দাবি জানান। মার্কেটের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা উন্নতমানের হওয়ার পরও আগুন কেন হঠাৎ বাড়ল, সেই প্রশ্নও তুলেছেন উপস্থিত অনেকেই। বসুন্ধরা সিটি দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এম এ হান্নান আজাদ বলেছেন, আগেও এখানে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের ঘটনাটি ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি এবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা হতে পারে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি দুটি বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত করবে। একটি হলো নাশকতা এবং অপরটি হলো বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। আগুন লাগার পর পরিদর্শনে আসা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আগুন লাগার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। দেশের অন্যতম বৃহত্তম বহুতল এই শপিং কমপ্লেক্সের পান্থপথ সড়কমুখী আটতলা ভবন এবং পেছনের দিকে রয়েছে ১৯ তলা ভবন। গতকাল বেলা প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে সামনের দিকের ছয়তলায় আগুনের সূত্রপাত। বসুন্ধরা সিটির নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ইউনিট এবং ফায়ার সার্ভিসের তাত্ক্ষণিক তত্পরতায় সেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দুপুরের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে ধোয়া বেরুচ্ছিল ছয়তলা ভবনের ভিতর থেকে। ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সারোয়ার খান বিকালে জানান, এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ১৯ জনকে উদ্ধার করেছে। এদের মধ্যে আটজনকে ফায়ার সার্ভিসের ল্যাডার দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে। আর ১১ জন নিজে নিজেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে একজন নারী। এদের প্রত্যেকেই সুস্থ রয়েছেন। এ ছাড়া আহত একজনকে রেড ক্রিসেন্টের অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ভিতরে আর কেউ আটকা নেই বলে তিনি নিশ্চিত করেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরে শেষ অবস্থায় যেমন হয়, এখন সে অবস্থায়ই রয়েছে। ভিতরের ধোঁয়ায় বাইরে থেকে মনে হচ্ছে— এখনো আগুন রয়েছে। আমাদের কর্মীরা কাজ করছেন, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে। অল্প সময় পরে ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু হবে’। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিটের ১৬০ জন কর্মী আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন, যাদের মধ্যে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীও রয়েছেন। শপিং মলের পঞ্চম তলায় রয়েছে জুয়েলারির দোকান। ষষ্ঠ তলায় মোবাইল, জুতা, ব্যাগ, ইলেক্ট্রিক পণ্যের দোকান। সপ্তম তলায় কয়েকটি ব্র্যান্ডের পোশাকের ও জুতার দোকান রয়েছে। অষ্টম তলায় ফুড কোর্ট ও সিনেপ্লেক্স অবস্থিত। আর নবম তলায় জেনারেটরের সরঞ্জাম। শপিং মলের বেজমেন্টে একটি সুপার শপ রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, তারা ১১টা ২৩ মিনিটে আগুনের সংবাদ পান। এরপর দ্রুত ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই সিটির ফায়ার ফাইটিং ইউনিট তত্পরতা শুরু করে। ঘটনার পরপর মার্কেটের সব লিফট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ঘটনাস্থলে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। একে একে ২৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তারা সিটির ফায়ার ফ?াইটিং ইউনিটের সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার তত্পরতার কাজ শুরু করে। মার্কেটের সামনের ভাগে ক্রেন দিয়ে আগুন নেভাতে থাকে তারা। কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর বেলা ১টার দিকে আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে ভিতর থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল। তীব্র বাতাসের কারণে আগুন নেভানোর কাজ চরমভাবে ব্যাহত হয়। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গোটা এলাকা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ল্যাডার দিয়ে মার্কেটের ভিতরে ঢুকে আটকে থাকা লোকজনদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এ সময় সামনের পান্থপথে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে মার্কেটের দোকান মালিক কর্মচারীরা ছুটে আসেন। উত্সুক জনতাকে সামাল দিতে পুলিশকে এ সময় বেগ পেতে হয়। বারবার বাঁশি বাজিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। পুরোটা সময় পুলিশ ও র‌্যাব অবস্থান নিয়ে থাকে মার্কেট ও তার আশপাশ এলাকায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস মার্কেটের ভিতরে সিটির জরুরি লাইট জ্বালিয়ে কাজ করছিল। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মিজানুর রহমান বিকাল সাড়ে ৪টায় বলেন, সিটির আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। দোকানগুলো তালাবদ্ধ থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল। তালা ভেঙে ভেঙে পানি দিতে হয়েছে। তালাবদ্ধ থাকায় আগুন দোকানের ওপর দিয়ে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ায় আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়েনি। দুপুরে ব্রিফিংয়ে বসুন্ধরা সিটির হেড অব মার্কেটিং জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ১১ জন কর্মী ভিতরে আটকা পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজন নারী ও আটজন পুরুষ। আমরা তাদের উদ্ধার করেছি। তারা প্রত্যেকেই সুস্থ রয়েছেন। ভিতরে আর আগুন নেই, এখন শুধু ধোঁয়া বের হচ্ছে। ইতিমধ্যে লেভেল ৮ এর সব পানির লাইন খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে পানি বের করে আগুন নেভানোর কাজ চলছে। আমাদের নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ইউনিটের ৬০-৬৫ জন কর্মী ভিতরে কাজ করছেন’। তিনি বলেন, ছয়তলার সি ব্লকের ৭ থেকে ৮টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন ছয়তলা থেকে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমরা আজই মার্কেট পরিষ্কার করে ফেলব। আশা করছি আগামীকাল বা পরশুর মধ্যে মার্কেট খুলে দেওয়া সম্ভব হবে। মার্কেটের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কিনা— সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা যেসব পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন আমরা সেগুলো নিয়েছিলাম। আজকে আপনারা দেখেছেন যে, আমাদের নিজস্ব ফায়ার ফাইটাররাই আগুন নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন।’ এর আগে ব্রিফিংয়ে সিটির সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক মোস্তফা রাহেল ইমাম বলেন, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিটির ছয়তলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। এর পরপরই সিটির নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ইউনিট ত্বরিত তত্পরতায় নামে। এরপর ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসও। এ জন্য আগুন ছড়াতে পারেনি। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ছয়তলায় একটি জুতার দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত। এরপর ৭-৮টি দোকানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তবে ছয়তলা থেকে যেন আগুন অন্য কোনো ফ্লোরে না ছড়ায় সেজন্য কাজ করে ফায়ার ফাইটিং ইউনিট ও ফায়ার সার্ভিস। তিনি বলেন, আগুন অলমোস্ট নিয়ন্ত্রণে। কোনো ক্যাজুয়ালিটি (হতাহত) নেই। আশপাশের কোনো ফ্লোরে যেন আগুন না ছড়ায় সেজন্য উপরের ফ্লোর থেকে পানি ছাড়া হয়েছে। এ কারণে আগুন কেবল ছয়তলায়ই থাকে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান জানান, সবার সহযোগিতায় আগুন নির্বাপণের কাজ সহজ হয়েছে।

ঘটনাস্থলে মেয়র আনিসুল হক : আগুন লাগার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। এ সময় তিনি বলেন, ‘বারবার কেন বসুন্ধরায় আগুন লাগে তা খতিয়ে দেখা হবে। সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং টিম নিয়ে এসেছি। ফায়ার সার্ভিস চাইলে সহযোগিতা নিতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে, প্রয়োজন হলে ব্যবহার করা হবে।

দোকান মালিক সমিতি : ঘটনাস্থলে উপস্থিত দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এম এ হান্নান আজাদ গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ষষ্ঠতলায় ১০০টি দোকান রয়েছে। যার মধ্যে ২৫ থেকে ৩০টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আনুমানিক ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, আগেও এখানে আগুন লেগেছিল। কিন্তু এবারের আগুনের প্রকৃতি ভিন্ন। নাশকতার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান মালিক সমিতির সভাপতি। তিনি এর তদন্তেরও দাবি জানান।

সর্বশেষ খবর