বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ব্যবসা-বাণিজ্যে হঠাৎ আঘাত

নৌ ধর্মঘটে সবকিছু অচল ♦ মিরপুর, বসুন্ধরা ও মৌচাক মার্কেটে আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যবসা-বাণিজ্যে হঠাৎ আঘাত

নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটে যাত্রীশূন্য ঢাকা সদরঘাট —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নতুন করে আঘাত শুরু হয়েছে। গতকাল নৌ ধর্মঘটে সারা দেশে বন্দরগুলো বন্ধ ছিল। শুধু যাত্রীবাহী লঞ্চ নয়, পণ্যবাহী লাইটার জাহাজগুলোও চলেনি নদীপথে। বন্ধ ছিল বাণিজ্য পরিবহন ব্যবহার করা সব প্রতিষ্ঠান। এদিকে, রাজধানীর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বসুন্ধরা সিটি মার্কেট গতকালও বন্ধ ছিল। আগুনের পেছনে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ছিল কিনা তা চিহ্নিত করার তদন্ত চলছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সকাল সাড়ে ১১টায় দোকানপাট খোলা হতো। এ সময় খাবার দোকানের পরিবর্তে জুতার দোকানে কীভাবে আগুন লাগল তা অপার রহস্য। জুতার আগুন ছড়াতেও সময় লাগে। কিন্তু দীর্ঘ সময় জুড়ে জ্বলতে থাকে। এ বিষয়টি মাথায় নিয়েই তদন্ত চলছে। এ ছাড়া একই সময়ে মিরপুরে দোকান ও মৌচাক মার্কেটে আগুন লাগা নিয়েও তদন্ত চলছে।  ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীর অভিজাত বিপণি বিতান বসুন্ধরা সিটি মার্কেটের ষষ্ঠতলায় নাশকতার উদ্দেশ্যেই আগুন লাগানো হয়েছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টাকারীরাই এমন গর্হিত কাজ করতে পারে বলে আশঙ্কা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও বসুন্ধরা সিটি মার্কেট কর্তৃপক্ষের। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত দুটি তদন্ত কমিটিও এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সকাল সোয়া ১১টার দিকে ষষ্ঠতলার সি-ব্লকের ৬০ নম্বর ‘স্মার্ট সুজ’ নামের দোকানে আগুনের সূত্রপাত। এর কিছুক্ষণ আগেই দোকানে প্রবেশ করেন কর্মচারী। অল্প সময়ের ব্যবধানে কীভাবে আগুন লাগল এবং অত্যাধুনিক সব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার পরও তা কীভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তা রীতিমতো ভাবনার বিষয়। স্বাভাবিকভাবে মার্কেটের অষ্টমতলায় খাবারের দোকানগুলো কিছুটা আগে খোলে। সাতসকালে খোললেও এসব দোকানে মানুষজনের ভিড় থাকে। এক্ষেত্রে ছয়তলার জুতার দোকানে আগুন লাগাটা রহস্যজনক।

সূত্র আরও বলছে, বসুন্ধরা মার্কেটে আগুন লাগার একদিন পর মৌচাক মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা বিশেষ কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। বসুন্ধরা মার্কেটে আগুনের দিন মিরপুরে একটি দোকানে আগুন লেগেছিল। তবে এসব আগুনের রহস্য বের করার জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। এদিকে, গতকাল বসুন্ধরা মার্কেটের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা টি আই এম লতিফুল হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগুন লাগার জন্য অনেকগুলো বিষয় আছে। লেভেল এইটের ফুডকোর্টে অনেকগুলো খাবারের দোকান আছে। ওই দোকানগুলোতে মাঝে মাঝেই আগুন লাগে এবং তা দক্ষতার সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে নেভানো হয়। এসব ক্ষেত্রে মার্কেট কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই। অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে। প্রতিটি দোকানে রয়েছে ফায়ার এক্সটিংগুইশার। রয়েছে যুগোপযোগী অগ্নিনির্বাপণ দল। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আগুন ধরেছিল টাওয়ারে। এতে কোনো ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হননি। ওই আগুনও আমরা সবাই মিলে জান বাজি রেখেই নিভিয়ে ছিলাম। গত রবিবারের ঘটনায়ও আমরা ফায়ার সার্ভিস টিমের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছি। লতিফুল বলেন, আমরা দ্রুততর সময়ের মধ্যেই মার্কেট খুলে দেওয়ার চেষ্টা করব। বিরামহীনভাবে কাজ চলছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে বসুন্ধরা সিটি দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এম এ হান্নান বলেন, আগুন ছয়তলার সি-ব্লকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাততলার কয়েকটি দোকান আগুনের তাপে কিছু ক্ষতি হয়েছে। আমাদের সবার প্রচেষ্টার কারণেই কম ক্ষতির মধ্য দিয়ে এটা সম্ভব হয়েছে। পুরোপুরি ব্যবসার উপযোগী করার পর মার্কেট খুলে দেওয়া হবে। অন্যদিকে, কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সোমবার মধ্য রাত থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কতিপয় শ্রমিক সংগঠন নৌ-ধর্মঘট আহ্বান করায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে অভ্যন্তরীণ এবং দূরপাল্লার সব নৌ রুটের যাত্রীবাহী নৌযানসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন আইন অনুযায়ী আকস্মিক ধর্মঘট ডাকা একেবারেই বেআইনি। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই আকস্মিক এ ধর্মঘটের ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে নৌপথে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, নৌপথনির্ভর দেশের অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়েছে কথিত নৌ ধর্মঘটের কারণে। নৌযান শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, শ্রমিকদের মজুরি ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা করাসহ ১৫ দফা দাবিতে এ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি থেকেও একবার লাগাতার ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। গতকাল থেকে ডাকা আকস্মিক এ ধর্মঘটের ফলে দেশের নৌবন্দরগুলোতে পণ্যবোঝাই ও খালাস এবং পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফলে অনেক স্থানেই নষ্ট হচ্ছে কাঁচামাল। ব্যবসায়ীরা পড়েছেন মারাত্মক ক্ষতির মুখে। জ্বালানিবাহী নৌযান চলাচলও বন্ধ রয়েছে। সরকারের নৌ-পরিবহন ও শ্রম মন্ত্রণালয় বলছে, তারা এই ধর্মঘটের বিষয়ে কিছুই জানে না। তাদের নোটিসে এরকম কোনো ধর্মঘটের খবর নেই। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত খবরের মাধ্যমেই তারা ধর্মঘটের বিষয়ে অবগত হয়েছেন। শ্রম অধিদফতরের পরিচালক আসাদুজ্জামান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আকস্মিক এই ধর্মঘটের বিষয়ে আমাদের নলেজে কিছু নেই। কারা ধর্মঘট ডেকেছে, কেন ডেকেছে সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। অফিসিয়ালি আমরা কোনো নোটিসও পাইনি। তিনি বলেন, আমরা নৌযান মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তারাও এ ধর্মঘটের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। আসাদুজ্জামান বলেন, তৈলবাহী জাহাজকে অন্য নৌ পরিবহন থেকে আলাদা খাত হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এ বিষয়ে খুব শিগগিরই গেজেট প্রকাশ করা হবে। ইতিমধ্যে তৈলবাহী জাহাজের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা তৈলবাহী জাহাজ মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠন মেনে নিয়েছে। এটি খুব শিগগিরই কার্যকর হবে। তবে কার্গো ভেসেল ও বিসিভোয়া আদালতে রিট করায় আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে তাদের বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

সাধারণত কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন এ ধরনের নৌযান ধর্মঘটের ডাক দিলেও এবার তাদের অবস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। কেন্দ্রীয়ভাবে এ ধর্মঘট ডাকা হয়নি বলে তারা দাবি করেছেন। নেতারা বলছেন, ধর্মঘটের বিষয়ে তারাও কিছু জানেন না। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব চৌধুরী আশিকুল ইসলাম বলেন, এ ধর্মঘটের ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা কোনো ধর্মঘট ডাকিনি। তবে আমরা শুনেছি স্থানীয়ভাবে নৌযান শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করছে। এটা তাদের ন্যায্য অধিকার। তারা এটা করতে পারে। কারণ তারা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য মজুরি থেকে। নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, নৌ ধর্মঘটের বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। তবে যারাই এ ধর্মঘট আহ্বান করুক না কেন তারা বেআইনি কাজ করেছে। তিনি বলেন, কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়া নৌ ধর্মঘট ডাকার কারণে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে নৌপথনির্ভর বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ও মালিক- শ্রমিকরা নৌ পরিবহন সেক্টরকে নিয়ে যে খেলা শুরু করেছে তা দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহূত কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় দাম বেড়ে যায়। যার দায়ভার প্রকারান্তরে সরকারের ওপরই চাপছে। এ ছাড়া বেশি প্রভাব পড়ছে নির্মাণ শিল্পের ওপর। ঢাকা নৌ বন্দর কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন গতকাল সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, প্রতিদিন স্বাভাবিকভাবে সদরঘাট থেকে ৬০-৬৫টি যাত্রীবাহী লঞ্চ ছেড়ে গেলেও আজ (গতকাল) ধর্মঘটের কারণে এ পর্যন্ত মাত্র ১০টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে, বাকি সময়ে আরও ১৩টি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ঘাটে তৈরি আছে।

বরিশাল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, সোমবার মধ্যরাত থেকে এই কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। নৌ-শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে এই ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলেও নৌযান শ্রমিকদের অন্যান্য সংগঠন এই কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। ফলে যাত্রী, পণ্য ও জ্বালানিবাহীসহ দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।  সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আকস্মিক ডাকা অনির্দিষ্টকালের এ ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নৌবন্দর। মঙ্গলবার ভোর থেকে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে কোনো জাহাজ নোঙর করেনি এবং কোনো জাহাজ বন্দর ছেড়েও যায়নি। পণ্যবাহী কোনো জাহাজ থেকেই শ্রমিকরা মালামাল খালাস করছেন না।

তবে তেলবাহী জাহাজগুলো ধর্মঘটের আওতামুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি জিন্নত আলী জানান, সরকার ও মালিকপক্ষ দাবিগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিলে গত তিন মাস আগে ধর্মঘট স্থগিত করা হয়। কিন্তু এত সময় পেরিয়ে গেলেও নৌযান শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, আকস্মিক ও অনির্দিষ্টকালের নৌযান ধর্মঘটের ফলে মংলা বন্দরে অবস্থানরত গম, সার, ক্লিংকার, পাথর, মেশিনারিসহ ১২টি দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহন কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ১৫ দফা দাবিতে লঞ্চ, বাল্কহেড, তেলবাহী ট্যাংকার, বালুবাহী নৌকা, লাইটার জাহাজসহ সব ধরনের নৌযান শ্রমিকরা একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মবিরতি পালন করছে। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্য নিয়ে আসা দুই শতাধিক কার্গো জাহাজ আশুগঞ্জ নৌবন্দরে আটকে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে আশুগঞ্জের সঙ্গে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় ৬টি নৌ-রুটের ৫ জেলা সিলেট, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৪ উপজেলার নৌ যোগাযোগ।

পূর্বাঞ্চলীয় কার্গো মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. নাজমুল হোসাইন হামদু জানিয়েছেন, আকস্মিক এ ধর্মঘটের কারণে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারখানার জরুরি কাঁচামাল নিয়ে জাহাজ আটকা পড়েছে। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনি জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব।

সর্বশেষ খবর