বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিভাজনরেখা এবং লর্ড র‌্যাডক্লিফের অনুশোচনা

কুলদীপ নায়ার

বিভাজনরেখা এবং লর্ড র‌্যাডক্লিফের অনুশোচনা

বাধ্য হয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে পরিত্যাগ করার সময় উপনিবেশকে বিতিকিচ্ছি অবস্থায় রেখে দেওয়ার কুখ্যাতি ব্রিটিশদের রয়েছে। এই কুকর্মটি তারা আয়ারল্যান্ডে করেছে, ফিলিস্তিন/ইসরায়েলে করেছে; ভারতে তো করেছেই।

আগস্ট মাস এলেই আমার মনে পড়ে লর্ড র‌্যাডক্লিফ নামের ব্রিটিশ আইনজীবীকে। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। ভারত ভাগ করে ভারত ও  পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সীমান্তরেখা নির্দিষ্ট করেছিলেন এই র‌্যাডক্লিফ। ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাকে নিয়ে এসেছিলেন উড়োজাহাজে করে। এর আগে র‌্যাডক্লিফ কখনোই ভারতে আসেননি, ভারত বিষয়ে তেমন কিছু তিনি জানতেনও না। র‌্যাডক্লিফ আমায় বলেছেন, মাউন্টব্যাটেন কী চান তা তিনি বললেন। র‌্যাডক্লিফ জানান, কাজটা তো খুবই কঠিন, এ কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয়। মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব দেন, কাজটা করে দাও, ৪০ হাজার রুপি দেব। সেকালে এটা বিরাট অঙ্কের অর্থ। র‌্যাডক্লিফ আমায় জানান, শেষতক তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল দু-দুটি দেশ সৃষ্টির জন্য তার কাঁধে অর্পিত দায়িত্ব। লন্ডনের স্বনামখ্যাত আইনজীবী র‌্যাডক্লিফ রাতারাতি হয়ে যাবেন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিদ, এই সম্ভাবনা এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে তিনি আর ‘না’ করলেন না। র‌্যাডক্লিফ বিভিন্ন জেলার মানচিত্র চাইলেন; ওরকম মানচিত্র একটাও ছিল না। তাকে দেওয়া হলো সাধারণ মানচিত্র যেরকম মানচিত্র সরকারি দফতর আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেয়ালে ঝোলানো থাকে। তিনি ভেবেচিন্তে ওই মানচিত্রের ওপরই রেখা টানতে থাকলেন। তিনি আমাকে বলেছেন, ওভাবে রেখা টানবার সময় তিনি লাহোর দিয়ে দিলেন ভারতে। একটু পরেই তিনি উপলব্ধি করলেন যে, এতে তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো শহরই পাকিস্তানে থাকবে না। তাই তিনি লাহোর এনে ফেললেন পাকিস্তানে। সে জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাঞ্জাবের মানুষ তাকে কখনো ক্ষমা করেনি; আজও না। ভাইসরয় ফি বাবদ যে ৪০ হাজার রুপি দিতে চেয়েছেন, র‌্যাডক্লিফ কখনোই তা নেননি। কারণ তার মনে হয়েছে যে, অভিবাসনের সময়কার হাঙ্গামায় প্রাণ হারানো এক কোটি মানুষের রক্ত তার বিবেকের গায়ে লেগে গেছে। দেশভাগ হওয়ার পর তিনি ভারতেও আর আসেননি। তিনি মারা গেছেন লন্ডনে। ভারতীয় সংবাদপত্রগুলো ‘লন্ডন টাইমস’-কে উদ্ধৃত করে তার মৃত্যুসংবাদ ছেপেছিল। র‌্যাডক্লিফ এমন এক ব্যক্তি যিনি দু-দুটি দেশ গড়ে দিলেন অথচ কোনো স্বীকৃতিই পেলেন না। তাকে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিদ মর্যাদাও দেওয়া হয়নি। বহু বছর পরে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে তার নেভাল এইড (অভিবাসনকালে যার বাবা-মার মৃত্যু ঘটেছিল) প্রশ্ন করেছিল, ‘পাকিস্তান বানিয়ে কোন ভালোটা হলো?’  বয়োবৃদ্ধ জিন্নাহ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তা তো জানি না হে নওজোয়ান। ভবিষ্যৎই বলবে কী ভালো হয়েছে।’ ভালো হয়েছে, না মন্দ হয়েছে, সেই অভিমত এখনই দিয়ে দেওয়াটা হয়তো ঠিক না। কিন্তু এটা তো পরিষ্কার যে, ভাগ করে দুই দেশ হওয়ার জন্য জিন্নাহ ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনরেখা টেনেছিলেন। জিন্নাহর জীবনচর্যার দিক থেকে ব্যাপারটি একটি পরিহাস। কারণ পানাহারের ক্ষেত্রে জিন্নাহ ধর্মের পরোয়া করতেন না। এমনকি যে উর্দুকে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলেন সেই উর্দুও তিনি উচ্চারণ করতেন তোতলিয়ে তোতলিয়ে, থেমে থেমে। পরিস্থিতি যখন এমন হয়ে পড়ছিল যে দেশভাগ করা ছাড়া উপায় নেই, মহাত্মা গান্ধী তখন নেহেরু ও প্যাটেলকে পরামর্শ দিলেন, তারা যেন অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য জিন্নাহকে প্রস্তাব দেন। গান্ধীর কথায় তারা দুজনই শিউরে উঠলেন। কারণ সর্বোচ্চ ওই পদে বসবার বাসনা তারা দুজনই বহু বছর ধরে পুষছিলেন। এতে এই আভাসই মেলে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিস্তর অবদান রাখলেও তারা ক্ষমতার লোভের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। সত্য এই যে, মহাত্মা গান্ধী নন, দেশভাগ ফর্মুলা মেনে নিয়েছিলেন নেহেরু ও প্যাটেল। দেশভাগ ফর্মুলা তৈরি করে ফেলার পর মাউন্টব্যাটেন আলোচনার জন্য প্রথমে ডাকলেন গান্ধীকে। তিনি ‘দেশভাগ’ কথাটাই শুনতে চাইলেন না। কথাটা মাউন্টব্যাটেন উচ্চারণ করা মাত্রই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন গান্ধী। নেহেরু ও প্যাটেল নিজেরা নিজেদের যুক্তি দেখালেন যে, তারা বেশিদিন বেঁচে থাকবেন না; দেশ যদি তারা গড়ে তুলতে চান তাহলে মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব মেনে নেওয়া উচিত। তাই তারা দেশভাগে রাজি হয়ে গেলেন।

বহুনিন্দিত জিন্নাহ তার ভাষায় ‘ঘুণে খাওয়া’ পাকিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। কারণ তিনি যে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা তা ছিল পেশোয়ার থেকে শুরু করে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশরা যতটুকু দিল ততটুকু গ্রহণ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। গোস্বাটা তার থেকে যাওয়ারই কথা। ব্রিটিশরা প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির বুদ্ধিতে মাউন্টব্যাটেন যেই বললেন, নতুন স্বাধীন দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখার কোনো ব্যবস্থা হয়ে গেলে তিনি মেনে নেবেন, সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহ বললেন, ‘আমি ওদের (ভারতীয়দের) বিশ্বাস করি না।’ জিজ্ঞাসা করা হলে কিছু কিছু লোক তখনো বলতেন যে, জিন্নাহ প্রধানমন্ত্রী হলে উত্তম প্রধানমন্ত্রীই হতেন এবং তাতে করে ভারত ঐক্যবদ্ধ থেকে যেত। তখনো কেউ জানত না যে, জিন্নাহ ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সারে ভুগছিলেন। সন্দেহ করা হয় যে, ব্রিটিশরা জানত এবং জানত বলেই দৃশ্যপট থেকে জিন্নাহ নিশ্চিহ্ন হওয়ার জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। তাদের ভাবনায় ছিল পাকিস্তান যেহেতু এক ব্যক্তির জজবা, দেশটা জন্ম দেওয়ার ধারণাটাও জিন্নাহর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে। নেহেরু অনুমান করতেন যে, পাকিস্তান বেশিদিন টিকবে না। গোপন করে রাখা জিন্নাহর ব্যাধির কারণেই যে তিনি এমনটা মনে করতেন, তা নয়। নেহেরু এবং কংগ্রেসের অন্যান্য শীর্ষ নেতার হিসাব বলছিল, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে চাঙ্গা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই পাকিস্তানের নেই।’ উইনস্টন চার্চিল কথা দিয়েছিলেন জিন্নাহকে। বলেছিলেন যে, জিন্নাহ যাতে সফল হন আর পাকিস্তান জন্ম নেয়, সেটা তিনি (চার্চিল) ব্যক্তিগতভাবে দেখবেন। এই অঙ্গীকারের বিষয়টি নেহেরু ও কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা কখনোই জানতে পাননি। হিন্দুদের প্রতি চার্চিলের বিকারগ্রস্ততার মতো ঘৃণা ছিল। তিনি বলতেন যে, তিনি বহুবর্ণের জটিল এই ধর্ম বোঝেন না। তুলনায় ইসলাম খুব সাধারণ এবং সহজবোধ্য। তবে ভিতরে ভিতরে চার্চিল কৌশলগত লাভ-লোকসানের দিকটাও বিবেচনা করতেন।

 ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানের অবস্থান এমন জায়গায় যে, তেলসমৃদ্ধ ইসলামী বিশ্বে প্রবেশের শুরু এখান থেকে করা যায়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নজরদারিও সহজ হয়। পাকিস্তানের মতো কৃতজ্ঞ একটা মক্কেল রাষ্ট্র পাওয়ার মোহ দমন অসাধ্য। বহু বছর পরে আমি লন্ডনে দেখা করি র‌্যাডক্লিফের সঙ্গে। নগরীর অত্যন্ত দামি ও আকর্ষণীয় এলাকা বন্ড স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটে বাস করছিলেন তিনি। দামি এলাকায় থাকেন, তাই ধরে নিয়েছিলাম যে, দেখভালের জন্য পরিচারকরা তাকে ঘিরে রাখবে। বিস্মিত হলাম। দরজা তিনি নিজেই খুললেন এবং চা বানানোর জন্য কেটলিটাও নিজেই চুলোয় বসালেন। দেশভাগ এবং তার দায়িত্ব সম্বন্ধে কথা বলতে তিনি খুবই অনিচ্ছুক। কিন্তু তার মুখোমুখি বসে আমি প্রশ্ন করায় তাকে জবাব দিতে হয়েছিল। তার সমস্ত চেহারায় অনুশোচনার ছায়া। দেখে মনে হচ্ছিল, দেশভাগের সময় যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছিল সেগুলো এখনো তার বিবেককে যন্ত্রণা দিচ্ছিল।

সর্বশেষ খবর