বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

আমার গলা দিয়ে সেগুলো নামতে চায় না

সমরেশ মজুমদার

আমার গলা দিয়ে সেগুলো নামতে চায় না

হারান মণ্ডলকে কেউ তার নাম ধরে ডাকত না। বলত, হারুচোর। আমাদের বাড়ির পাশেই তিস্তা নদী। তার ঘাটে মাঝে মাঝে হারুচোরকে দেখা যেত। যারা নৌকাতে জিনিসপত্র তুলে দিত তারা বলত, ...দোহাই হারু, এখানে চুরি করিস না। বাবুরা ভাববে আমরাই মাল সরিয়েছি।

আমরা ভাবতাম শহরের সবাই যখন জানে লোকটা চোর তাহলে চুরি করে কী করে? মাসে অন্তত দু-তিনবার সে জেলে যায় তখন ওর বউ-ছেলে খুব বিপাকে পড়ে। আমার বড়পিসিমা হারান মণ্ডলের স্ত্রীকে বাড়ির কাজে নিয়েছিলেন। তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে সে প্রতি সকালে কাজে আসত। বড়পিসিমা তাকে বলতেন, ...তোর স্বামীকে বল ওসব ছেড়ে সত্ভাবে রোজকার করতে। বউটি জবাব দিত, ...ওকে তো কেউ কাজ দেয় না মাসিমা। সবাই সন্দেহ করে। এই হারুচোরের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। বোধহয় আমাকে পছন্দ করত বলে মনের কথা বলত। পেটের দায়ে সে চুরি করে কিন্তু জেলে গেলে তার কান্না পায় বউ-ছেলেদের কথা ভেবে। জেলে সে পেট ভরে খেতে পায়। তার খুব ইচ্ছে করে ওদের সঙ্গে নিয়ে জেলে যেতে। কতবার সে বলেছে বউকে, আয় একসঙ্গে চুরি করি। ট্রেনে চুরি করা সহজ। অপরিচিত লোকজন তাকে দেখে সতর্ক হয় না। আর তাতেও যদি ধরা পড়ে তাহলে কয়েক মাস খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু বউ রাজি হয়নি ছেলের কথা ভেবে। এইখানেই আটকে গেছে হারুচোর। সে মরে গেলেও ছেলেকে চোর হতে দেবে না। মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ...হারুদা, চুরি করে মাসে কত পাও?

--আগে ভালোই হতো। এখন মানুষ এত সেয়ানা হয়ে গেছে।

--শ্বাস ফেলে বলেছিল হারুচোর, ...কত আর? কপাল ভালো থাকলে কয়েক দিন চলে যায়।

জলপাইগুড়ি ছেড়ে এসেছি বহুকাল হয়ে গেল। মাঝে মাঝে কাজকর্মে গিয়ে হোটেলে উঠেছি। পূর্বপুরুষ এবং মহিলারা গত হওয়ার পর ওখানকার বাড়িও বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তবে বন্ধুরা থাকায় শহরটাকে নিজের বলেই মনে হয়। কিন্তু হারুচোরের খবর নেওয়া হয়নি।

একবার একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে হোটেলে উঠেছিলাম। সকালবেলায় একজন বৃদ্ধ এসে জিজ্ঞেস করল, ...নমস্কার দাদাবাবু, আমাকে চেনা যাচ্ছে?

মলিন পোশাক, মুখে পাকা দাড়ি, শীর্ণ চেহারার মানুষটার দিকে তাকিয়ে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলাম। বৃদ্ধ হাসল, ...চিনবে কী করে? এখন তো মরতে বসেছি। পুলিশ আর পাবলিকের হাতে এত মার খেয়েছি!

--হারুদা না? চেঁচিয়ে উঠলাম।

--যাক, আমারই জিত হলো। ...হাসি ফুটল মুখে।

--মানে?

--বউ বলেছিল তুমি নাকি এত নাম করেছ যে আমাকে চিনতেই পারবে না। বলেছিল, মানসম্মান তো নিজেরটা খুইয়েছ, ছেলেরটাও খোয়াবে? হারুচোর বলল, ...কিন্তু তুমি তো আমাকে ভুলে যাওনি।

--না, ভুলিনি। কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি তুমি ভালো নেই।

--না নেই, একদম নেই।

--কিছু মনে কর না, তুমি কি এখনো চুরি কর?

--করলে তো ভালোই হতো। জেলের ভাত খেয়ে শরীর ফিরে যেত। ...হারু বলল, ...এখন বাড়িতে জল খাবার হয় লুচি-পরোটা, দুবেলা মাছ-মাংস, কিন্তু আমার গলা দিয়ে সেগুলো নামতে চায় না।

--সে কি! ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

--কোনো ডাক্তারের সাধ্য নয় যে!

--কেন?

--আমি চোর, সারা জীবন চুরি করেছি কিন্তু ছেলের চুরির রোজগারের টাকায় কেনা খাবার গলা দিয়ে নামাতে পারব না। -- করুণ স্বরে বলল হারুচোর।

-- অ্যাঁ! তোমার ছেলেও চুরির লাইনে গিয়েছে।

--কী বলব! ভেবেছিলাম, পড়াশোনা করে ছেলেটা সৎ জীবনযাপন করবে। সবাইকে বলতে পারব, আমি চোর ছিলাম কিন্তু ছেলে আমার সৎ। আমার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে দাদাবাবু। অথচ দেখুন, আমার বউ, সারা জীবন আমাকে ঘেন্না করে এসেছে অথচ ছেলে চোর হওয়া সত্ত্বেও সে ডাঁট দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দামি শাড়ি পরছে, গয়না বানাচ্ছে। কি বিচার। --হারুচোর কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগল।

--তুমি তো বহুবার জেলে গেছ, তোমার ছেলের কি জেল হয়েছে?

--আমি ছোট চোর ছিলাম। লোকে বলত ছিঁচকে চোর। তাই দু-তিন মাস জেল হতো। কিন্তু ছেলে অনেক বড় চোর, তাই এক-দুদিনের বেশি ওকে থাকতে হতো না। ইদানীং তো আর যেতে হয় না। ...হারু বলল।

শুনে অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম। ...কোথায় থাকে সে?

--আমার বাপ ঠাকুরদার জমিতেই দোতলা বাড়ি করেছে সে। ওর মা মেয়ে খুঁজছে বিয়ে দেবে বলে। বউ কী বলে জানেন? বলে, অনেক দিন তো এখানে পড়ে আছ। এবার তীর্থবাস কর। যা পাপ করেছ তাতে নরকবাস করবে। তীর্থে গেলে একটু যদি পুণ্যি-টুন্যি হয়! ...শ্বাস ফেলল হারু, ...ভাবুন আমাকে এখান থেকে না সরাতে পারলে ওদের শান্তি হচ্ছে না। ছেলের বাপ চোর ছিল বলে নাকি ভালো মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। বলছে, বৃন্দাবনে গিয়ে থাকো, নয়তো হরিদ্বারে যাও। টাকা দেবে ছেলে।

ওর বউ-ছেলের সমস্যা বুঝতে পারলাম। সত্যি তো, চোরের ছেলের সঙ্গে কোনো বাবা তার মেয়ের বিয়ে দেবে? কিন্তু ছেলেটাও তো চোর! তার বেলা?

হারু বলল, ...বাড়িতে যাই না। মন্দিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে ভোগ খেয়ে পেটের জ্বালা নেভাই। ছাদের ঘরে পড়ে থাকি। কবে যে মরব ঠিক নেই!

--তোমার ছেলে কী চুরি করে যে এত কম জেল হয়?

--জেল হতো আগে। তখন আন্দোলন না কীসব করত। এখন হয় না।

এখন সে কাউন্সিলর। ভোটে জিতে হয়েছে। দু’হাতে চুরি করছে। কত মানুষকে সে ঠকাচ্ছে তার হিসাব নেই। বউ বলে, ও কেন চোর হবে? ও রাজনৈতিক নেতা। বউ এখন নেতার মা। যেই সরকার পাল্টে যাবে অমনি চোর হয়ে জেলে যাবে। আমি সেই দিনের জন্য বেঁচে আছি দেখব বলে, দাদাবাবু!

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর