শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

এমপিরা যখন ব্যবসায়ী

হলফনামায় কৃষিজীবী ও শিক্ষক উল্লেখ থাকলেও বেশিরভাগই পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী, কেউ কেউ ব্যবহার করছেন পরিবারের সদস্যদের নাম

গোলাম রাব্বানী

এমপিরা যখন ব্যবসায়ী

দশম জাতীয় সংসদের এমপিরা প্রায় সবাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেকে নিজেদের হলফনামায় রাজনীতিবিদ উল্লেখ করলেও বাস্তবে তারা পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। কেউ কেউ ব্যবসায়ী পরিচয় না দিলেও নিজের ও পরিবারের নামে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা। আবার অনেক এমপি শিক্ষকতাকে পেশা দেখালেও আয় দেখিয়েছেন ব্যবসা থেকে। আবার এমপি হওয়ার পরই কারও কারও পাল্টে গেছে পেশাও। আগে ব্যবসা না করলেও এমপি হয়েই জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসার সঙ্গে। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এমপিরা নিজেদের ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রায় সবার আয়ের মূল উৎস হচ্ছে ব্যবসা। ৩৫০ জন এমপির হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, হাতে গোনা কয়েকজন এমপি ছাড়া প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। শতকরা হিসেবে শুধু ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২.২৮ শতাংশে। তবে সংরক্ষিত আসন বাদ দিলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশে। আয় বিশ্লেষণ করে পেশা নির্ধারণ করা হলে এ সংখ্যা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

জাতীয় সংসদ সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনে দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এমপিদের মধ্যে ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন ২১৮ জন, আইনজীবী ৪৮ জন, রাজনীতিকে পেশা বলেছেন মাত্র ২২ জন। এ ছাড়া কৃষিজীবী ২১ জন, চাকরিজীবী-অধ্যাপনা ১৭ জন, গৃহিণী ৭ ও অন্যান্য পেশার ১৭ জন রয়েছেন। তবে অনেকেই একাধিক পেশার সঙ্গে জড়িত বলেও উল্লেখ করছেন। এমনকি ইসিতে দেওয়া হলফনামার সঙ্গে সংসদ সচিবালয়ে সংরক্ষিত সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত তথ্যে গরমিলও পাওয়া গেছে।

ব্যবসায়ী মোট ২১৪ এমপির মধ্যে আওয়ামী লীগেরই ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৪, স্বতন্ত্র ১৪ জন এবং জাসদ, তরীকত ফেডারেশন, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি মিলিয়ে ৬ জন। মোট ৯ জন এমপির পেশার বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি সংসদ সচিবালয়ের কাছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে ১২৮ জন (৩৬.৫৭ শতাংশ) স্নাতকোত্তর এবং ১৪৭ জন (৪২ শতাংশ) স্নাতক পাস। ২১ জন এসএসসি ও ৩৭ জন এইচএসসি পাস। ১৫ জনের (৪.২৮ শতাংশ) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে।

হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ের একজন সংসদ সদস্য হলফনামায় নিজেকে কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও তার আয় রয়েছে মত্স্য চাষ থেকে। ওই জেলার আরেক সংসদ সদস্য নিজেকে অধ্যাপক হিসেবে পরিচয় দিলেও হলফনামায় ব্যবসা থেকেও আয় দেখানো হয়েছে। পঞ্চগড়ের একজন সংসদ সদস্য হলফনামায় নিজেকে আইনজীবী উল্লেখ করলেও সংসদ সচিবালয়ে দেওয়া তথ্যে নিজের পেশার সঙ্গে কৃষিও জুড়ে দিয়েছেন। লালমনিরহাটের একজন সংসদ সদস্য হলফনামায় নিজেকে কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করলেও সংসদে দেওয়া তথ্যে নিজেকে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। দেখা যায়, দশম সংসদের এমপিদের মধ্যে ব্যবসা পেশার সংখ্যাই বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে আইন আর তৃতীয়তে আছেন রাজনীতি পেশার সদস্যরা। স্বল্পসংখ্যক সদস্যের পেশা কৃষি, শিক্ষকতা ও চিকিৎসা। কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাও এমপি হয়েছেন। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে অবশ্য ব্যবসায়ীর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ একজন সংসদ সদস্য ‘গ্রুপ অব কোম্পানি’র মালিক হলেও তার পেশা হিসেবে রাজনীতিকেই দেখানো হয়েছে। একইভাবে আরেকজন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নেতার কোনো পেশা দেখানো হয়নি। জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর যে হার ১৫% ছিল তা এখন অতীতের সব রেকর্ড পেছনে ফেলে ৬৯%-এ এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য সংসদগুলোর ধারাবাহিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৫৪ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। পরে ধারাবাহিকভাবেই এটি বেড়েছে। স্বাধীনতার দুই বছর পর প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে ১৫% ব্যবসায়ী ছিলেন সংসদে।

এরপর সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় ব্যবসায়ী, সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের ডেকে ডেকে করা হয়েছে এমপি। মাত্র ছয় বছরে ১৯৭৯ সালে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫%। এরপর শুধুই বেড়েছে দুর্বৃত্তায়ন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের পরও সেই একই ধারা অব্যাহত ছিল। ১৯৯৬ সালে এসে ব্যবসায়ী এমপির হার হয়েছে ৪৮%, পরে ২০০১ সালের সংসদে এ হার হয় ৫১% এবং ২০০৮ সালে মোট এমপির ৬৩ শতাংশই ছিলেন ব্যবসায়ী। সেসব রেকর্ডও এখন ভঙ্গ হলো। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ও অতীতের ধারাবাহিকতায় সরকারের চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই দখল করেছেন পেশায় ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, সদ্য নিম্নমধ্য আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পাওয়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। যেমন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে ৩৮% ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সে এ হার ২৫%।

সংরক্ষিত আসনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য : পেশাগত দিক থেকে তুলনামূলক বিচারে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপিদের মধ্যেও রয়েছে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। এর মধ্যে ব্যবসায়ী রয়েছেন ১২ জন, আইনজীবী ১০ জন, বাকিরা অন্যান্য পেশার। তবে সংরক্ষিত নারী এমপিদের মধ্যে ২৪ শতাংশ কোটিপতি, যাদের নিজ ও নির্ভরশীলদের নামে ন্যূনতম ১ কোটি টাকার ওপরে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রায় ১০ জন কোটিপতি। ৫ কোটি টাকার ওপরেও সম্পদ রয়েছে ১ জনের (২.৬৩%)। জাতীয় পার্টির ১ জনের ৫ কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে।

কোটিপতি এমপির ছড়াছড়ি : বাংলাদেশে রীতিমতো কোটিপতি এমপির ছড়াছড়ি। দুই বছর আগের নির্বাচনী হলফনামা নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের একটি গবেষণা অনুসারে, দশম সংসদের ২২৬ জন অর্থাৎ ৬৫% এমপির কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯৪ জন এমপি অর্থাৎ ৭১%ই কোটিপতি। জাতীয় পার্টির ১৮ জন বা ৪৫% এমপির কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। জাসদের ৬ ও ওয়ার্কার্স পার্টির ১ জন এমপি কোটিপতি। তরীকত ফেডারেশনের ২ এমপির ২ জনই কোটিপতি। স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে ৮ জন কোটিপতি। সম্পদের বাইরে আয়ের বিবেচনায় ৫৫ জন এমপির বার্ষিক আয় কোটি টাকার ওপরে বলে জানায় সুজন। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রচলিত ধারা অনুসারে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের সম্পদের পরিমাণ সব সময়ই বৃদ্ধি পায়। সে হিসেবে কোটিপতি এমপিদের ঘোষিত সম্পদ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা জানতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হওয়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ও অব্যাহত আছে। এ কারণেই রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে গেছে। অনেকেই রাজনীতিকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছেন। অর্থলিপ্সার এ সুযোগে তৈরি হচ্ছে গডফাদার, টেন্ডারবাজ ও সুবিধাভোগী নেতা। স্বার্থের কারণে হচ্ছে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাস।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর