শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

চাকরি বাজারে বিদেশিদের আধিপত্য

বাংলাদেশিদের ছাঁটাই করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো নিয়োগ দিচ্ছে চীন, কোরিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের

জুলকার নাইন

চাকরি বাজারে বিদেশিদের আধিপত্য

বাংলাদেশে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের চাকরির বাজারে ক্রমেই বিদেশিদের আধিপত্য বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য বাংলাদেশি থাকার পরও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের। আবার বাংলাদেশি কর্মী ছাঁটাই করে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাও সম্প্রতি ঘটিয়েছে ঢাকায় অবস্থিত কয়েকটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি।

টেলিকম খাতের অন্যতম কোম্পানি হুয়াইতে এক যুগের বেশি সময় কাজ করার পরও ছাঁটাই হতে হয়েছে অর্ধশতাধিক বাংলাদেশিকে। তাদের পরিবর্তে চীন, কোরিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা পাচ্ছেন নতুন নিয়োগ। চাকরিচ্যুত বাংলাদেশিদের যৌক্তিক কোনো কারণও দর্শাচ্ছেন না নিয়োগ কর্তারা। বিপরীত দিকে যথাযথ অনুমোদন ছাড়া ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন বিদেশিরা। অবশ্য শুধু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোই নয়, বাংলাদেশি অনেক কোম্পানিও এখন বিদেশি কর্মকর্তা নিয়োগের দিকে ঝুঁকছেন। অনেকেই বিদেশি কর্মকর্তা নিয়োগ করলে নিজের কোম্পানির সম্মান বাড়ছে বলে মনে করছেন। তাই বিশেষজ্ঞ বা কারিগরি কোনো কাজে নয়, নিছক প্রশাসনিক দায়িত্বেও নিয়োগ পাচ্ছেন বিদেশিরা। ফলে উৎসাহ হারাচ্ছেন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বাংলাদেশি চাকরি প্রত্যাশীরা। দেশ হারাচ্ছে মেধাবী ও দক্ষ কর্মীদের।

বিভিন্ন সূত্র মতে, বাংলাদেশে গার্মেন্ট কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং,  বেসরকারি বিদ্যুেকন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানি, মোবাইল ফোন কোম্পানি, এয়ারলাইনস, ফার্নিচার কোম্পানি, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়। এরপরই রয়েছে শ্রীলঙ্কা, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ আফ্রিকা, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। বিদেশিরা কর্মরত আছেন এমন একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, কোম্পানিতে পাঁচ বাংলাদেশি কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন একেকজন বিদেশি কর্মকর্তা। সেই বিদেশি কর্মকর্তা আবার নীতিনির্ধারণী পোস্টে তার স্বদেশি কোনো নাগরিক বা অন্য কোনো বিদেশিকেই নিয়োগ দিচ্ছেন, বাংলাদেশিদের নিচ্ছেন না। মানা হচ্ছে না বিনিয়োগ বোর্ডের বিদেশি নিয়োগের শর্তও। যেমন— আইনানুসারে একজন বিদেশি নিয়োগ দিতে হলে তার বিনিময়ে পাঁচজন বাংলাদেশি নিয়োগ দিতে হয়। আবার আইনে নিযুক্ত বিদেশি নাগরিকের কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে বিদেশিকে বিদায় দেওয়ার কথাও বলা আছে। এর কিছুই মানা হচ্ছে না। বছরের পর বছর থেকে যাচ্ছেন বিদেশিরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশিদের মোট সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। আসলে প্রকৃত তথ্য নেই কোথাও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বৈধ বিদেশি আছেন এক লাখ ১১ হাজার ৫৭৫ জন। বাংলাদেশে ২০ হাজার ৬৫৬ জন ভারতীয় অবস্থান করছেন। ভারতীয়রা এদেশে বিনিয়োগকারী, বিভিন্ন সংস্থা/কারখানা ও উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিদ্যুৎ সেক্টরে কর্মরত। কিছু ভারতের নাগরিক চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এর মধ্যে ৯১০ জন বিদেশি নাগরিকের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। পুলিশের বিশেষ শাখায় অবৈধ বিদেশিদের তালিকা সংরক্ষিত আছে। অবৈধভাবে চাকরিরত বিদেশির সন্ধান পেলে তাত্ক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনে বলা আছে। নিয়মানুযায়ী, বাংলাদেশে  বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে বিনিয়োগ বোর্ড থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। ইপিজেডগুলোতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুমোদন নিতে হয় বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা বেপজার। এনজিও ব্যুরো থেকে অনুমোদন দেওয়া হয় এনজিওগুলোর বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন হয় বিদেশি খেলোয়াড় আনতে। এসব অনুমোদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশে প্রায় ১৬ হাজার বিদেশি কাজ করছেন। এর মধ্যে আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডে এখন অনুমতি নিয়ে বৈধভাবে কাজ করেন তিন হাজারের মতো বিদেশি। বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতিতে আছেন ১৩ হাজার বিদেশি কর্মী। আর এনজিও ব্যুরোর অনুমতি নিয়ে কাজ করা বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ৫০০। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশে ২০ হাজার ভারতীয়র চাকরির কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গত বছরের এক গবেষণায় বলা হয়, ভারতে পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ হলো বাংলাদেশ। এদেশে প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় কাজ করেন। তারা তাদের দেশে এক বছরে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান। অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকের কার্যকর অনুমোদন নেই।

ট্যুরিস্ট ভিসায় চাকরি, ফাঁকি দিচ্ছে ট্যাক্স : বিদেশিদের চার ভাগের তিনভাগই ভ্রমণ বা ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসছেন। অথচ আসছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের উদ্দেশ্যেই। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে ছুটি নিয়ে গিয়ে আবার নতুন ভ্রমণ ভিসায় আসছেন বাংলাদেশে। বিনিয়োগ বোর্ডের কোনো অনুমোদন নেওয়া হচ্ছে না। ফলে তাদের বেতন পরিশোধের বিষয়গুলোও নজরদারিতে আসছে না। নিয়োগদাতা কোম্পানিগুলোও বিভিন্ন অসৎ উপায়ে রাজস্বমুক্ত খাত থেকে তাদের বেতন পরিশোধ করছে। হুন্ডিতে টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে।

সর্বশেষ খবর