শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
বিএনপির চিন্তা নতুন দুই ইস্যু নিয়ে

জিয়ার স্বাধীনতা পদক ও খালেদা জিয়ার মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

হঠাৎই নতুন চিন্তায় পড়েছে বিএনপি। দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রত্যাহারে সরকারি সুপারিশের সিদ্ধান্তে টেনশন বাড়িয়ে দিয়েছে দলটিকে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার খড়্গ তো আছেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা নিয়ে নেতা-কর্মীদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এরই মধ্যে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এক মামলায় সাত বছরের সাজা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়েও উৎকণ্ঠায় নেতা-কর্মীরা। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশ যখন জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদসহ জাতীয় সংকটে ঠিক সেই মুহূর্তে জিয়াউর রহমানের “স্বাধীনতা পদক” প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সরকারের চরম জিঘাংসারই বহিঃপ্রকাশ।’

বুধবার জাতীয় পুরস্কারসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে পদকটি জাতীয় জাদুঘর থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এটি অনুমোদনের জন্য শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকসূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো সম্মানীয় ব্যক্তিকে পদক দিয়ে কেড়ে নেওয়া সভ্যসমাজে দেখা যায় না। এটা অরুচিকর ও নোংরামি। এটা জাতীয় সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। কারণ, জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতাও ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তাকে সাহসিকতার কারণে বীরউত্তম খেতাব দেন। কিন্তু সরকার কাকে বেইজ্জত করতে গিয়ে কাকে অসম্মান করছে, তা বোধগম্য নয়। আমি আশা করি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত দিয়ে অন্তত এ সিদ্ধান্তটি হবে না।’

বিএনপি সমর্থিত আরেক বুদ্ধিজীবী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের স্বাধীন পদক প্রত্যাহারে সুপারিশের সিদ্ধান্ত যদি কোনো কমিটি করে থাকে, তা খুবই ভুল সিদ্ধান্ত। এটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি করতে পারেন না। যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য চিকিৎসা জরুরি। কোনোভাবেই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।’

জানা যায়, জিয়ার স্বাধীনতা পদক কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এমন খবরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমে এমন খবর আসার বিষয়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও বিস্ময় প্রকাশ করেন। পরে তিনি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার নির্দেশনা দেন। সরকার যদি নীতিগতভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এ নিয়ে রাজপথে যাওয়ার চিন্তাভাবনাও করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছু নয়। বিএনপি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজনীতিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু সরকার সংকীর্ণ বিভাজনের রাজনীতির পথে হাঁটছে। সমগ্র জাতি যখন ঐক্যের রাজনীতি সমর্থন করছে, তখন আওয়ামী লীগ বিভাজনের রাজনীতি করে বিরোধী মতকে হরণ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করছে। এই ভয়াবহ বিভাজনের রাজনীতি পরিত্যাগ করে ঐক্যের পথে ফিরে আসার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় ঐক্য এবং গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।’

এদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনেকটাই ‘অনিশ্চিত’ হয়ে পড়েছে। অর্থ পাচার মামলায় সাজা নিয়ে এ সরকারের আমলে তার সশরীরে আপিল করার সম্ভাবনাও কম। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করলে সংবিধানসম্মতভাবেই আগামী সাত বছর সব ধরনের নির্বাচনে অযোগ্য হবেন তিনি। একইভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রমও শেষ পর্যায়ে। এ মামলায়ও বেগম জিয়ার ‘সাজার’ আশঙ্কা করছেন দলের আইনজীবীরা। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকেও আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। পরে জামিন চেয়ে আপিল করার বিধান আছে। সরকার হার্ডলাইনে থাকলে তাকেও সাজার ঘানি টানতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ হতে পারেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীও। বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

বিএনপির আইনজীবীরা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রায়ও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ঘোষিত হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার সাজা দেবে এটা অনেকটাই পরিষ্কার। নইলে এ দুই মামলাই ভিত্তিহীন। এতদিন এ মামলা চলতে পারে না। এ ছাড়া নাইকো ও গ্যাটকো দুর্নীতি মামলাসহ ২৭টি মামলার আসামি বেগম জিয়া। সব মামলার বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে চলছে বলে বিএনপির আইনজীবীরা জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া জানান, ‘জিয়া পরিবারকে সাজা দিতে সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। এরই মধ্যে এক মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলায়ও আমরা ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা করছি। উদ্দেশ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে রাখা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এসব মামলায় ন্যায়বিচার পেলে সবই মিথ্যা প্রমাণিত হবে।’

জিয়ার স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার সংকীর্ণ সিদ্ধান্ত : প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রিসভা কমিটির ‘সিদ্ধান্তে’ বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিষয়টি সংকীর্ণ মানসিকতা, আত্মঘাতী এবং নোংরা কাজ।’ গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে গণমাধ্যমে এসেছে, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার হচ্ছে। এই সংবাদে আমরা এবং গোটা জাতি বিস্মিত এবং উদ্বিগ্ন। যিনি পদক প্রবর্তন করলেন তিনি বাদ, কিন্তু পদক থাকবে, তার কীর্তিও থাকবে। এটা যে কত বড় সংকীর্ণতা, আত্মঘাতী এবং নোংরা কাজ; তা আওয়ামী লীগ যেদিন বুঝবে সেদিন আর শোধরানোর  সময় থাকবে না।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের দলীয় মূল্যায়ন আমরা সবাই জানি। কিন্তু দলীয় মূল্যায়নে রাষ্ট্র চলে না, রাষ্ট্র সবার। এই রাষ্ট্রকে যদি দলীয় বানাতে চান তখন রাষ্ট্র থাকবে, দলই থাকবে না। জিয়াউর রহমান শুধু ইতিহাসে নয়, বহু মানুষের হৃদয়ে আছেন পরম শ্রদ্ধায়। কাজেই তিনি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবেনই। যারা গায়ের জোরে নোংরাভাবে তাকে মুছতে চাচ্ছেন, তাতে তারাও হয়তো মুছে যেতে পারেন।’

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আহমদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপি সরকার ২০০৩ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে একই সঙ্গে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দিয়েছিল বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরম ঔদার্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই সম্মাননা বিতর্কিত এবং অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার কমিটিতে বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ যে রাজনীতি করছে, তা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হতাশা এবং দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লক্ষ করছি, এই সরকার ঐক্যের রাজনীতিকে বিসর্জন দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে গোটা জাতিকে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বিভক্ত করে ফেলছেন।’

 

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সামরিক ক্ষেত্রে শৌর্যবীর্য ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে মেধা, কৃতিত্ব যোগ্যতা ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে দেশি-বিদেশি কাউকেই কোনো রাষ্ট্রীয় খেতাব ও পদক দেওয়াকে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। একাডেমিক অনার ছাড়া বিদেশ থেকে কোনো সম্মাননা অর্জনকেও রাষ্ট্রপ্রতি প্রাক অনুমোদন গ্রহণ করার শর্ত যুক্ত করেছিলেন তারা। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় সম্মাননার ওপর আরোপিত সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ১৯৭৭ সালে দেশে প্রথম স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক প্রবর্তন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তাদের পদক প্রদান করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর