সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাঁচতে পারল না স্কুলছাত্রী রিশা

বখাটেকে গ্রেফতারে বিক্ষোভ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাঁচতে পারল না স্কুলছাত্রী রিশা

দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে আহত স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা (১৪) চলে গেল না ফেরার দেশে। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) তিনি হেরে যান। রিশা রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। এর আগে ২৪ আগস্ট দুপুরে কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজের ওপর দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে রিশা গুরুতর আহত হন। চিকিৎসকরা বলছেন, রিশার পেটের বাঁ দিকে ও বাঁ হাতে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে রিশার মৃত্যুর সংবাদে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা ক্লাস বর্জন করে স্কুলের সামনের রাস্তায় নেমে আসেন। সেখানে তারা মানববন্ধন করেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। রিশা নিহতের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাস্তায় অবস্থান নেন তার সহপাঠীরা। এতে কাকরাইলসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রিশা হত্যার বিচার দাবিসহ আজ সোমবারের ক্লাস

বর্জনের ঘোষণা দেন তারা। এ ঘটনায় আজ বেলা সাড়ে ১১টায় স্কুলে শোকসভা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন ঘটনাস্থলে এসে পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও ক্লাস বন্ধের ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন। রিশার সহপাঠী আন্দোলনরত পিয়ালী সাহা বলেন, রিশাকে যে হত্যা করেছে তাকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। হত্যাকারীকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। রিশার সহপাঠী আশা বলেন, ‘রিশা মেধাবী ছাত্রী ছিল। সব সময় হাসিখুশি থাকত। ক্লাসের সবাইকে মাতিয়ে রাখত। তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করায় আমরা হতবাক ও মর্মাহত। আমরা রিশার হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’ শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে স্কুলে ফেরত পাঠানো হয়েছে জানিয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি মারুফ হোসেন সরদার বলেন, মূল আসামি ওবায়দুলকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এক ছাত্রীর অভিভাবক রেহানা আক্তার শিল্পী বলেন, ‘রিশার আজ এ অবস্থার জন্য বর্তমান অধ্যক্ষ অনেকটা দায়ী। আগের অধ্যক্ষ আর্মি ছিলেন। তিনি নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু বর্তমান অধ্যক্ষ নিজের নিরাপত্তার কথা বেশি ভাবেন।’ স্কুলটির অভিভাবক ফোরামের সভাপতি আঞ্জুমান আরা বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কেন রিশা আজ মারা গেল, আমরা এর জবাব চাই। আমাদের মেয়েরা এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। আমরা আমাদের সন্তানের নিরাপত্তা চাই।’ অধ্যক্ষ আবুল হোসেন বলেন, ‘রিশা মারা যাওয়ায় আমরা খুব কষ্ট পেয়েছি। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। আমরা আশা করি দ্রুত আসামিকে গ্রেফতার করতে পারবে পুলিশ।’ নিরাপত্তার ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অভিভাবকরা এমন বলতেই থাকেন। আমাদের স্কুলের সামনে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার আছে। কিন্তু যেখানে মেয়েটাকে মারা হয়েছে তা স্কুল থেকে বাইরে।’ এদিকে বারবার সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিলেন রিশার বাবা রমজান হোসেন। জ্ঞান ফিরলেই বুক চাপড়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমি এখন কী করব, কোথায় যাব। এত বড় ছেলে (বৈশাখী টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল) কেমনে আমার মেয়েটাকে মারল। আমি এখন কাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করব। আমাকে রেখে গেলি ক্যান, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যা মা।’ নিহতের চাচা নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘রিশা চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিল। সব সময় হাসিখুশি থাকত। এলাকার সবাই রিশাকে আদর করত।’ নিহতের মামা কামাল উদ্দিন মুন্না জানান, রিশার বাবা রমজান আলী একজন কেব্ল্ ব্যবসায়ী এবং মা তানিয়া হোসেন গৃহিণী। ওই দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে। তারা বংশালের সিদ্দিকবাজার এলাকায় ১০৪ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় থাকেন। নিহত রিশা সবার বড় ছিলেন। এ ছাড়া ওই দম্পতির দুই সন্তান রবি (৯) ও খুকু (৫)। এদের মধ্যে রবি তৃতীয় শ্রেণি এবং খুকু কেজিতে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলেই পড়ছে। মুন্না বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে ওবায়দুল ডিস লাইনের কথা বলে বাসায় ফোন করে রিশার বাবার মোবাইল নম্বর নেয়। এক সপ্তাহ আগে ফোন করে সে জানায়, আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। নইলে আপনার মেয়েকে হত্যা করা হবে। কিন্তু পরিচয় গোপন রেখে দিয়ে ফোন দেওয়ায় রিশার বাবা বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি।’ ২৪ আগস্ট দুপুরে পরীক্ষা শেষে স্কুল থেকে বেরিয়ে কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজের ওপর ওঠেন রিশা। ব্রিজের মাঝামাঝি যেতেই এক দুর্বৃত্ত তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। রিশার চিৎকারে স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ছুটে আসেন। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে এবং পরে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকালে রিশা মারা যান। ঘটনার দিন রাতে রিশার মা তানিয়া হোসেন বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রমনা মডেল থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় ওবায়দুল নামে এক যুবককে আসামি করা হয়েছে। মামলায় উল্লেখ করা হয়, প্রায় ছয় মাস আগে মায়ের সঙ্গে রিশা ইস্টার্ন মল্লিকার শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে যান। সেখানে একটি ড্রেস সেলাই করতে দেন তারা। দোকানের রিসিটে বাসার ঠিকানা ও তার মায়ের মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল। সেই রিসিট থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে ওই টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল ফোনে রিশাকে উত্ত্যক্ত করত। পরে ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দিলে ওই বখাটে স্কুলে যাওয়ার পথে রিশাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় রিশাকে ছুরিকাঘাত করে ওবায়দুল। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা মডেল থানার এসআই মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই ওবায়দুল পলাতক রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও। বৈশাখী টেইলার্স মালিকের দাবি অনুযায়ী, ওবায়দুল আড়াই মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এরপর কোথাও চাকরি বা অন্য কিছু করত কি না তা জানা যায়নি। মোবাইল ট্র্যাকিং এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে তার অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে। শিরগিরই তাকে ধরতে পারব বলে আশা করছি।’ গতকাল স্কুলছাত্রী রিশার লাশ ঢামেক মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে জানাজার জন্য নেওয়া হয়। সেখানে সহপাঠী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের কান্নায় স্কুলের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। বাদ আসর জানাজা শেষে তার লাশ নেওয়া হয় বংশালের আলাউদ্দিন রোডের ঘাট সাহেব মসজিদে। সেখানে আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী শেষবারের মতো রিশার লাশ দেখতে ভিড় করেন। সেখানে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ। বাদ মাগরিব দ্বিতীয় জানাজা শেষে তার লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এদিকে স্কুলছাত্রী রিশার হত্যাকারীর বিচার দাবি করেছে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। গতকাল এক বিবৃতিতে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হুসাইন বলেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে। সামাজিক অবক্ষয়ের ফলেই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আজ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতিই একমাত্র সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর