শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

রিশার জন্য কাঁদছে সবাই

ক্ষোভ-বিক্ষোভ, খুনি ওবায়দুল কোথায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

রিশার জন্য কাঁদছে সবাই

রিশা হত্যার বিচার দাবিতে গতকালও বিক্ষোভ করে সহপাঠীরা —জয়ীতা রায়

ক্ষোভে উত্তাল রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ। কালও শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে ওঠে প্রতিষ্ঠানটির চত্বর। সহপাঠী সুরাইয়া আক্তার রিশার (১৪) খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে উইলস লিটলের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে ছিলেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। গতকাল কাকরাইল থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। এদিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার চেয়ে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী। এ ছাড়া রিশার মৃত্যুর পর সন্দেহভাজন খুনি ওবায়দুলকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে হত্যাকারীকে ধরতে এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। রিশার মৃত্যুর ঘটনায় তার সহপাঠী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে চলছে শোকের মাতম। তারা মেনে নিতে পারছেন না তার অকালে চলে যাওয়া। রিশার বাবা-মার সঙ্গে আর্তনাদ করছেন অন্য শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাও। প্রতিষ্ঠান চত্বরে কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন রিশার মা তানিয়া হোসেন। উইলস লিটল মিলনায়তনে এক শোকসভায় যোগ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আমি খুনির ফাঁসির দাবি করছি। আমরা এই খুনিকে ধরতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করব। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে যা করা প্রয়োজন তা-ই করা হবে।’ এ সময় তিনি একই স্কুলের শিক্ষার্থী রিশার ভাই রবি হোসেন ও বোন রোদেলার মধ্যে রিশার ছায়া খুঁজে

পাওয়ার আহ্বান জানান। শোকসভা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আইসিটি শ্রেণিকক্ষ রিশার নামে নামকরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা ‘এসো বোন, এসো ভাই, রিশা হত্যার বিচার চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভে সংহতি জানাতে এসে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘তনু হত্যার যদি বিচার হতো তাহলে রিশাকে এভাবে হত্যা করা হতো না। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। এসব ঘটনার একটিরও সুষ্ঠু বিচার হয়নি। যারা এসব হত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করে আসছে, তাদের আন্দোলনকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তনুর পর আফসানা, এরপর রিশা—এভাবে একের পর এক নারী হত্যা চলছেই।’

সমাবেশে যোগ দিয়ে রমনা বিভাগের পুলিশের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে গ্রেফতার করা হবে।’ এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। এদিকে রিশাকে হাসপাতালে নিতে উইলস লিটল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন অভিভাবক ফোরামের আহ্বায়ক শামীমা আক্তার ও সদস্যসচিব আঞ্জুমান আরা। তাদের অভিযোগ, যেদিন রিশার পেটে ছুরি মারা হয়, সেদিন অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় স্কুলের বারান্দায় নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে গাড়ি চায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটি পুলিশ কেস বলে গাড়ি দেয়নি। তারা রিশাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করেনি। পরে রিশার বন্ধুরা তাকে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। এ সময় তারা উইলস লিটলের বর্তমান অধ্যক্ষকে অপসারণ এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বিসিএস কর্মকর্তাকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের দাবি জানান। একই দাবিতে আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সামনে মানববন্ধনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা।

অভিযোগ অস্বীকার করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার কাছে কোনো গাড়ি চাওয়াই হয়নি। তারা ফ্লাইওভার থেকেই রিশাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেছে। পরে আমাকে খবর দেওয়া হয়।’ রিশার বাবা রমজান হোসেন ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমিও শুনেছি আমার মেয়েকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারে স্কুল থেকে কোনো গাড়ি দেওয়া হয়নি। তাদের যথেষ্ট গাফিলতি ছিল। ভ্যানে না দিলে আমার মেয়েটার এ অবস্থা হতো না।’ আহাজারি করে তিনি বলেন, ‘সহপাঠীরাই আমাকে ফোন দিয়ে জানায় রিশার ছুরিকাহত হওয়ার খবর। তারা বলে, তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে আসেন। তারপর আমরা গিয়ে দেখি, আমার মেয়েটা শুধু চিৎকার করছে। ওর মাকে শুধু বলছে, টেইলার্সের ওই লোকটা আমাকে মারছে মা। পুলিশের কাছেও জবানবন্দি দিয়ে গেছে সে। আইসিইউতে আমার সামনে চোখ খুলেছিল। ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে দেখে আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। শুধু বলেছি, বাবা, তুমি ভয় পেয়ো না। আমরা তোমার সামনে আছি। তখন হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি আমার দুই হাত দিয়ে ওর দুটো হাত ধরলাম। কিন্তু মেয়েটারে বাঁচাতে পারলাম না।’ রিশার আহত পরবর্তী মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ছুরিকাহত করা হয় স্কুলের সামনের ফুটওভার ব্রিজে। সেখান থেকে রিশা রক্তাক্ত অবস্থায় এসে দাঁড়ায় স্কুলের ভিতরে। তখন তার পেটের বাঁ দিক থেকে রক্ত ঝরছিল। তখন স্কুলের একটি গাড়ি পাশেই ছিল। কিন্তু চাওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ গাড়ি দেয়নি। কোনো শিক্ষক এগিয়ে আসেননি। এ অবস্থায় প্রথমে কলেজ সেকশনের দুজন শিক্ষার্থী এসে ওর ওড়না খুলে পেট বেঁধে রক্ত থামানোর ব্যবস্থা করে। এরপর তাকে পাশের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে নেওয়ার পর তারা গুরুতর আহত বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।’ রিশার মা তানিয়া হোসেন বিলাপ করে বলেন, ‘আমার বাচ্চার রক্ত ঝরছিল। কিন্তু প্রিন্সিপালসহ কেউ এগিয়ে আসেননি। শিক্ষার্থীরা কোলে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার পেটের ভিতর থেকে নাড়ি বের হয়ে গিয়েছিল।’ এইচ কে সাব্বির নামে স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, রিশা অত্যন্ত চঞ্চল ও মেধাবী ছিল। সে সব সময় হাসিমুখে সবার সঙ্গে কথা বলত। অত্যন্ত মায়াবী ও মিশুক ছিল রিশা। বুধবার উইলস লিটলের সামনের ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামছিল রিশা। সেখানেই স্কুলড্রেস পরা অবস্থায় রিশাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানকার আইসিইউতে রবিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার দিনই তার মা বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছেন রমনা থানার এসআই মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। দ্রুতই এর ফল পাওয়া যাবে।’ মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, প্রায় ছয় মাস আগে মায়ের সঙ্গে ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে যায় রিশা। সেখানে একটি ড্রেস সেলাই করতে দেয় সে। ওই সময় দোকানের ক্যাশ মেমোতে বাসার ঠিকানা ও তার মায়ের মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়। সেই ক্যাশ মেমো থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল খান (২৯) রিশাকে ফোনে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। পরে ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দিলে স্কুলে যাওয়ার পথে রিশাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে ওবায়দুল। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় রিশাকে ছুরিকাঘাত করা হয়।

গ্রেফতার চেয়ে নোটিস : স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ওবায়দুলসহ জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার চেয়ে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইউনুচ আলী আকন্দ ডাকযোগে এ নোটিস পাঠান। স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকার পুলিশ কমিশনার ও রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নোটিসে বিবাদী করা হয়েছে। গতকাল পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হুসাইন বলেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে। সামাজিক অবক্ষয়ের ফলেই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আজ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

সর্বশেষ খবর