মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

কেরির সফরে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত তিনটি

জিন্নাতুন নূর

কেরির সফরে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত তিনটি

মোহাম্মদ জমির

‘মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সফরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত আমরা দেখতে পেয়েছি। এগুলো হলো—সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য ভাগাভাগি, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরত দেওয়া বিষয়টি পর্যালোচনা করা এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আস্থা বেড়েছে তা এ সফরের মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট হয়েছে।’ গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরা-বারিধারা আবাসিক এলাকায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, জন কেরির সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে সন্ত্রাস দমন ইস্যুতে দেশটি বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায়। আর জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ যে জিরো টলারেন্স অবস্থান দেখিয়েছে, এরও প্রশংসা করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইতিবাচক বিষয় এই যে, যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার সহযোগিতার অংশ হিসেবে তাদের ইন্টেলিজেন্স বা গোয়েন্দাতথ্য বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করার বিষয়ে রাজি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রথম বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা অবস্থান করছেন। আর কেরি তার এই সফরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের ফেরত দেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পর্যালোচনা করবেন বলে সরকারকে আশ্বাস দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তৃতীয়ত, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সফরে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ডিউটি ফ্রি কোটা চেয়েছে। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ডিউটি ফ্রি কোটা পেলে আমাদের সুবিধা হবে। আর এটি জিএসপি থেকে বেশি গুরুত্ব বহন করে। কারণ রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের যদি ভিয়েতনামসহ অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, তবে বাংলাদেশের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার হবে। অন্য দেশগুলো  যুক্তরাষ্ট্রে ডিউটি ফ্রি কোটাসুবিধা ভোগ করছে। আর বাংলাদেশ যদি তা না পায় তাহলে আমরা পিছিয়ে যাব। আর এ ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন। যেহেতু আমরা টিকফা চুক্তি সই করেছি, এ কারণে বাংলাদেশ অবশ্যই জিএসপি সুবিধা আশা করতে পারে। একইভাবে আমরা ডিউটি ফ্রি কোটা পাওয়ার বিষয়টিও আশা করতে পারি।’ তবে জলবায়ু, জ্বালানি ও স্বাস্থ্যের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ আরও কিছু ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে বলে সাবেক এই কূটনীতিক মনে করেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে ব্লু ইকোনমির কাজে অগ্রগতির জন্য কারিগরি ও কৌশলগত অনেক বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা লাগবে। বিশেষ করে সেখানে তেল আছে কি না, গ্যাস উত্তোলন ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশকে জানানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রাখতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি এ অনুসন্ধান কার্যক্রমে জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসও বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চায়। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে চায়, তবে তা হবে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক।’ জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহযোগিতার বিষয়ে মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। এ বিষয়ে তারা বলা চলে ‘জ্ঞানী-গুণী’। অনেকেই বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ নিয়ে যে ইস্যু সৃষ্টি হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রই সৃষ্টি করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছে কী করেনি সে ব্যাপারে আমি মতামত প্রকাশ করব না। এটি ঠিক যে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে তথ্য-ভাগাভাগির জন্য রাজি হয়েছে। এটি বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইতিবাচক উদ্যোগ বলে বিবেচনা করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জঙ্গিবাদ দমনের জন্য ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করছি। আমাদের দেশ থেকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত অভিজ্ঞতার জন্য বাংলাদেশি র‌্যাব-পুলিশ ফোর্স যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। সেখানে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এ ছাড়া সাইবার নিরাপত্তার জন্য যে কারিগরি দিকগুলো আছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশি বাহিনী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা গত কয়েক বছরে ৫৪টি দেশে শান্তি রক্ষার কাজে যুক্ত হয়েছি। এর মাধ্যমে আমরাও জঙ্গি দমনে যতটা কাজ করা প্রয়োজন তা করব। কিছুদিন আগে এখানে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও সফরে এসেছিলেন। সেসব সূত্র ধরে আমি বলব, দক্ষিণ এশিয়ায় কাউন্টার টেররিজমে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা হয় আর সেখানে যুক্তরাষ্ট্র যদি বলে যে তারা আমাদের সঙ্গে আছে, তবে তা আমাদের জন্য সুখবর।’ মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিও জন কেরির এ সফরে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন উঠেছিল, সে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় বসেছে। এমনকি তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কনফিডেনশিয়াল তথ্যও বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করছে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, তারা সরকারকে বৈধ বলে গণ্য করছে। সে কারণেই এখন আর সরকারের বৈধতার প্রশ্ন নেই। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আস্থা আছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, এ সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র খুশি।’

সর্বশেষ খবর