শিরোনাম
বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

মীর কাসেমের ফাঁসি কখন

রিভিউ আবেদন খারিজ, রায়ের কপি কারাগারে । বাকি শুধু প্রাণভিক্ষা । আজ হরতাল জামায়াতের

আহমেদ আল আমীন

মীর কাসেমের ফাঁসি কখন

আদালতের সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ। আইনি লড়াইয়ের সব ধাপেই হারলেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী। এবার তার ফাঁসির অপেক্ষা। এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে অর্থাৎ তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ গতকাল সকালে যে রায় দেয়, বিকালে তার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। সুপ্রিমকোর্ট থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে সেই রায় কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় গত রাতেই। এখন ফাঁসি কার্যকরের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার প্রসঙ্গটি শুধু বাকি। তিনি প্রাণভিক্ষা চাইলে সেই আবেদনের নিষ্পত্তির আগে ফাঁসি কার্যকর করা যাবে না। প্রাণভিক্ষা নাকচ হলে বা না চাইলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আর কোনো বাধা নেই। সরকার চাইলে যে কোনো সময় মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে। রিভিউ খারিজের খবর সকালেই রেডিওতে শুনেছেন মীর কাসেম আলী।

এর আগে সকালে রিভিউ আবেদন খারিজ করে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এই রায়ের প্রতিবাদে আজ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। এর আগে ১৯৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপি-জামায়াতের পাঁচ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক খাতের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে পরিচিত এই মীর কাসেম ১৯৭১ সালে ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের ঘাতক সংগঠন আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান। পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য। বিচারিক আদালতে প্রমাণিত দশ অভিযোগের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার একাদশ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। এ ছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয়, সপ্তম, নবম, দশম ও চতুর্দশ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মোট ৫৮ বছরের দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগে। তবে চতুর্থ, ষষ্ঠ ও দ্বাদশ অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন মীর কাসেম। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকারপক্ষ। তবে আসামিপক্ষ বলছে, মিথ্যা অভিযোগ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে মীর কাসেমকে এ সাজা দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল ৯টা ২ মিনিটে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন বিচারপতিরা। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। ৯টা ৪ মিনিটের দিকে আদালত রায় ঘোষণা করে। আদালত জানায়, মীর কাসেমের আপিলের রায়ে আগে একটি অংশে ভুল ছিল। চতুর্দশ অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আপিলের রায়ে তাকে সাজা দেওয়া হয়নি। সেই অভিযোগে তাকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১০ বছরের সাজা বহাল রাখা হলো। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ এবং আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান। এই মামলায় আসামিপক্ষে নেতৃত্ব দেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তবে তিনি রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। রায় ঘোষণা উপলক্ষে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এদিকে ফাঁসি বহালের খবরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল হয়েছে।

চূড়ান্ত রায় কারাগারে : মীর কাসেমের ফাঁসির চূড়ান্ত রায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিকালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা ২৯ পৃষ্ঠার রিভিউর রায় প্রকাশ করে। এর আগে পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা। পরে সেই রায় পাঠানো হয় এই মামলার বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সন্ধ্যায় সেই রায়ে স্বাক্ষর করে কেন্দ্রীয় কারাগারে তা পাঠানো হয় রাতেই। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, বিচারিক আদালতের বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর রাতেই রায়ের কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

ফিরে দেখা : মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেফতার হন মীর কাসেম। পরে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। ২০১৩ সালের ১৬ মে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয় ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর। ৩০ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে মামলাটি স্থানান্তর করা হয় ট্রাইব্যুনাল-২-এ। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল যুক্তিতর্ক শুরু করে প্রসিকিউশন। মামলাটি ট্রাইব্যুনালে রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয় ওই বছরের ৪ মে। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেন। গত ৮ মার্চ মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। সেই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি রিভিউ আবেদন করেন।

কে এই মীর কাসেম : ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মীর কাসেম আলীর জন্ম মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে। ডাকনাম পিয়ারু ওরফে মিন্টু। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় থাকতেন চট্টগ্রামে। সেখানে জড়িত হন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে। ’৭১ সালের ৭ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ’৭৭ সালে নাম বদল করে তার নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রশিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই সংগঠনটি। মীর কাসেম হন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তী সময়ে তিনি যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীতে। একাত্তরে চট্টগ্রামে অবস্থানের সময় টর্চার সেল স্থাপন করেন ডালিম হোটেল নামে পরিচিত স্থানীয় মহামায়া হোটেলে। সেখানে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার বহু সমর্থককে। ছাত্রসংঘের বাছাই করা কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত আলবদর বাহিনীর তিনি ছিলেন তৃতীয় কমান্ডার। এই ঘাতক বাহিনীতে নেতৃত্ব ও প্রভাব বিবেচনায় তার অবস্থান ছিল মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পরই। আর বিশেষভাবে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে বদরবাহিনীর প্রধান। এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসেবে। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামীকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ করেন তিনি। বহু আর্থিক, বাণিজ্যিক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা, পরিচালক মীর কাসেম আলী দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান।

মীর কাসেমের যত অপরাধ : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেম আলীর বিচার হয় ১৪ অভিযোগে। তবে বিচারিক ওই আদালতে প্রমাণিত হয় দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ ও চতুর্দশ; এই ১০টি অভিযোগ। এর মধ্যে একাদশ অভিযোগে সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও দ্বাদশ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় মীর কাসেমকে। প্রমাণিত অন্য আট অভিযোগে মোট ৭২ বছরের দণ্ড পান তিনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে আপিল বিভাগে চতুর্থ, ষষ্ঠ ও দ্বাদশ অভিযোগ থেকে খালাস পান মীর কাসেম। অন্য সাত অভিযোগ প্রমাণিত হয় আপিল বিভাগে। এসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ডও বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। রিভিউ আবেদনের রায়েও আপিল বিভাগের সেই রায় বহাল রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে অপহরণ করে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় লুত্ফর রহমান ফারুককে। তৃতীয় অভিযোগ, ২২ বা ২৩ নভেম্বর মীর কাসেমের নেতৃত্বে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয় ডবলমুরিং থানা এলাকার কদমতলীর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে। সপ্তম অভিযোগ, মীর কাসেমের নেতৃত্বে আল বদর সদস্যরা ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরীসহ দুজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে ডালিম হোটেলে। নবম অভিযোগ, ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের নেতৃত্বে সৈয়দ মো. এমরানসহ ছয় জনকে অপহরণ ও নির্যাতন। দশম অভিযোগ, ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের নির্দেশে মো. জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরণ ও নির্যাতন করে আলবদর সদস্যরা। একাদশ অভিযোগ, একাত্তরের ঈদুল ফিতরের পর যেকোনো এক দিন মীর কাসেমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে অপহণের পর নির্যাতন করে আল বদর সদস্যরা। নির্যাতনে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচ অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। চতুর্দশ অভিযোগ, নভেম্বরের শেষ দিকে মীর কাসেমের নেতৃত্বে আল বদর সদস্যরা নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ ও নির্যাতন করে আল বদর সদস্যরা। একাদশ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও তৃতীয়, সপ্তম, নবম ও দশম অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় মীর কাসেমকে। আর দ্বিতীয় অভিযোগে ২০ বছর এবং চতুর্দশ অভিযোগে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় বিচারিক আদালতে। 

জামায়াতের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আজ : জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি বহাল থাকার প্রতিবাদে আজ সারা দেশে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করেছে দলটি। গতকাল আপিল বিভাগ মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহালের আদেশ দেওয়ার পর দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তবে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, হজযাত্রীদের বহনকারী যানবাহন ও সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাড়ি এ হরতালের আওতামুক্ত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর