শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শপথ ভেঙেছেন দুই মন্ত্রী

আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

শপথ ভেঙেছেন দুই মন্ত্রী

কামরুল ইসলাম, আ ক ম মোজাম্মেল হক

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে মন্তব্য করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মামলা (বিচারাধীন) নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে করা মন্তব্যে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের আদালত অবমাননার বিষয়ে এ মামলার সংক্ষিপ্ত রায় হয়েছিল গত ২৭ মার্চ। সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর গতকাল সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ  রায় প্রকাশিত হয়। ৫৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, সংবিধান রক্ষায় দুই মন্ত্রী যে শপথ নিয়েছিলেন, তা তারা ভঙ্গ করেছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আদালত এ মন্তব্য করে। পূর্ণাঙ্গ রায় অনুসারে, দুই মন্ত্রীর মন্তব্যে আদালত অবমাননা হয়েছে এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আট বিচারপতিই একমত হয়েছেন। তাদের শাস্তি হিসেবে জরিমানার বিষয়েও তারা একমত। তবে শপথ ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করছেন পাঁচজন বিচারপতি, বাকি তিনজন শপথ ভঙ্গ হওয়ার বিষয়ে একমত নন। শপথ ভঙ্গ হয়েছে বলে যারা মনে করেন তারা হলেন— প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। রায়ের এ অংশটি লিখেছেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। রায়ে প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচ বিচারপতি বলেন, সংবিধানের আলোকে আইনের শাসন রক্ষার ক্ষেত্রে বিবাদীরা তাদের শপথের প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। তারা আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং সংবিধান রক্ষা ও সংরক্ষণে তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন। অন্যদিকে দুই মন্ত্রীর শাস্তির বিষয়ে একমত হলেও তারা শপথ ভঙ্গ করেননি বলে মনে করেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি নিজামুল হক। এ অংশের রায় লিখেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। রায়ে বলা হয়েছে, ‘আদালত অবমাননা এবং তার জন্য ধার্যকৃত জরিমানা বিষয়ে তারা একমত হলেও তারা মনে করেন না সংবিধান রক্ষায় দুই মন্ত্রী শপথ ভঙ্গ করেছেন।’ গত ৫ মার্চ ঢাকায় ঘাতক-দালাল নির্মূল  কমিটির এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় মীর কাসেমের রায় নিয়ে কামরুল ইসলাম ও মোজাম্মেল হক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করেছিলেন। এরপর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের প্রতি আদালত অবমাননার রুল জারি করে। রুলের শুনানি শেষে এ রায় দেওয়া হয়েছিল। এর আগে দুই মন্ত্রীর পক্ষে গত ১৪ মার্চ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে নোটিসের জবাব দাখিল করা হয়। আদালতের তলবে ১৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক হাজিরা দেন। তবে, বিদেশে থাকায় সেদিন হাজির হতে পারেননি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তার সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে ২০ মার্চ ফের দুই মন্ত্রীকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০ মার্চ দুই মন্ত্রী আপিল বিভাগে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। ২৭ মার্চ দুই মন্ত্রীকে ফের হাজিরের নির্দেশ দেয়। পরে উভয়েরই আবেদন খারিজ করে দিয়ে আদালত বলে, মন্তব্যের মাধ্যমে আদালত অবমাননা করেছেন তারা। তাদের সাত দিনের মধ্যে জরিমানার টাকা ইসলামীয়া চক্ষু হাসপাতাল ও কিডনি ফাউন্ডেশনকে দিতে বলা হয়। পরে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন দুই মন্ত্রী। কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার। মোজাম্মেল হকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে মন্ত্রীদের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন গ্রহণ না করার কারণ এবং যুক্তি ও রেফারেন্সসহ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নিছক কয়েক লাইনে ক্ষমা প্রার্থনা করলেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এটা গ্রহণ করা হলে তা অনেকেরই বিচার বিভাগ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা অভ্যাসে পরিণত হতে পারে। কিন্তু আপিল বিভাগ তার নিজের ও বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ।’ রায়ে বলা হয়, ‘বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা (দুই মন্ত্রী) বিচার বিভাগের মর্যাদাকে খাটো করেছেন। তারা রায় প্রদান প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে সুপ্রিমকোর্ট সম্পর্কে কুৎসা রটনা করেছেন। এটা মারাত্মক ফৌজদারি আদালত অবমাননা এবং সংবিধানে প্রদত্ত ব্যবস্থার লঙ্ঘন। এ কারণে তারা সহানুভূতি পেতে পারেন না। এ জন্য তাদের ন্যূনতম সাজা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।’  রায়ে বলা হয়েছে, ‘তারা (দুই মন্ত্রী) আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং সংবিধান সমুন্নত রাখার যে শপথ নিয়েছেন তা লঙ্ঘন করেছেন। আমাদের সন্দেহ নেই যে, বিবাদীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বক্তব্য রেখেছেন এবং তারা তাদের দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। তারা আইন ভঙ্গের কাজ করেছেন।’ সংবিধানের শপথ ভঙ্গের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করা তিন বিচারক অভিমত দেন— ‘তাদের (দুই মন্ত্রী) শপথ ভঙ্গ করার বিষয়টি এই আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল না। শপথ ভঙ্গের বিষয়টি তাদের নজরেও (নোটিসে) আনা হয়নি। যারা এখনো মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে তারা আদালত অবমাননা করেছেন কি করেননি, সেটাই বিবেচ্য বিষয়।’ শপথ ভঙ্গের পরেও দুই মন্ত্রীর পদে থাকা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সংবিধান ও আইনে এ ব্যাপারে ওইভাবে কিছু বলা হয়নি। বিষয়টি জনমতের ওপর নির্ভর করে। তারা মন্ত্রী হিসেবে পদে থাকতে পারবেন কিনা, জানতে হলে জনমত যাচাই হোক।

সর্বশেষ খবর