শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আড়াই বছরেও বৈঠক হয়নি প্রেসিডিয়ামের, চার বছর জাতীয় কমিটির

আওয়ামী লীগের রাজনীতি

রফিকুল ইসলাম রনি

আড়াই বছরেও বৈঠক হয়নি প্রেসিডিয়ামের, চার বছর জাতীয় কমিটির

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ‘প্রেসিডিয়াম’ ও ‘জাতীয় কমিটি’কে। তবু গেল আড়াই বছরে প্রেসিডিয়াম এবং প্রায় পৌনে ৪ বছরে হয়নি জাতীয় কমিটির বৈঠক। দলের সাংগঠনিক সব সিদ্ধান্তই হয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে। তাই, অন্য ফোরামের বৈঠকের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না বলে দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ফোরামগুলো ‘কিছুটা অকার্যকর’ হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। একই অবস্থা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের ক্ষেত্রেও। এ পরিষদেরও নিয়মিত বা পৃথক বৈঠক ডাকা হয় না। মাঝেমধ্যে কার্যনির্বাহী সংসদের সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভা ডাকা হলেও কার্যত গুরুত্বহীন থিঙ্ক ট্যাঙ্কার নামে পরিচিত এই ফোরামটি।

দলের গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম বা সভাপতিমণ্ডলী যে কোনো বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্তের পর তা কেন্দ্রীয় কমিটি বা কার্যনির্বাহী সংসদে পাস করানো হয়। গঠনতন্ত্রের ২৫-এর ‘খ’ ধারা অনুযায়ী কার্যনির্বাহী সংসদ বা কাউন্সিলের অনুমোদনসাপেক্ষে জরুরি ও অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রেসিডিয়াম সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

নীতিনির্ধারক একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন প্রেসিডিয়াম সদস্যরা। তবে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের পর প্রেসিডিয়ামের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সর্বশেষ ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় কাউন্সিলের পর গঠিত বর্তমান প্রেসিডিয়ামের সদস্যরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। দু-একটি সভার পর গত প্রায় আড়াই বছরে এই ফোরামের আর কোনো সভা হয়নি। সর্বশেষ সভা কবে হয়েছে তা প্রেসিডিয়ামের অনেক সদস্য বলতেই পারেন না। তবে দলের দফতর সূত্রে জানা যায়, সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী এই ফোরামের সর্বশেষ সভা হয়েছে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় কমিটি। ৬ মাস অন্তর জাতীয় কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও পৌনে ৪ বছর ধরে তা আহ্বানই করা হয়নি। সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর। দীর্ঘদিন আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক না হওয়ার জন্য বিগত দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই দায়ী করছেন দলের নেতারা। জাতীয় কমিটির সদস্যরা কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ‘দীর্ঘদিন বৈঠক ডাকা হয় না। আমরা কমিটিতে আছি কিনা তাও জানি না।’ দলের গঠনতন্ত্রের ১৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির মোট সদস্য হবেন ১৬৬ জন। এর মধ্যে প্রত্যেক সাংগঠনিক জেলা থেকে একজন করে মোট ৭৩ জন, দলীয় সভানেত্রীর মনোনীত ২১ জন, অন্যান্য ৬ জন। ১৭(খ) অনুযায়ী, জাতীয় কমিটি দলের কাউন্সিল ও কার্যনির্বাহী সংসদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। অনুচ্ছেদ ১৭(ঝ) অনুযায়ী প্রতি ৬ মাস অন্তর জাতীয় কমিটির বৈঠক হবে। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্র থাকছে উপেক্ষিত। কবে নাগাদ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে তাও জানেন না জাতীয় কমিটির সদস্যরা। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আইনে প্রতি বছরই রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিতে হয়। গঠনতন্ত্রের ১৭(ঙ) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের হিসাব-নিকাশ ও বাজেটের অনুমোদন দেবেন জাতীয় কমিটির সদস্যরা। কিন্তু ২০১২ সালের পর আর কোনো বৈঠক ডাকা হয়নি। নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগ ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে আয়-ব্যয়ের হিসাব ঠিকই জমা দিয়েছে। কমিটির অনুমোদন ছাড়া কীভাবে এ হিসাব জমা দেওয়া হলো, কেউ বলতে পারেননি। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা দাবি করছেন, আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্র মেনেই সবকিছু করে। নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের হিসাব অবশ্যই জাতীয় কমিটির অনুমোদন নিয়েই দেওয়া হয়েছে। রংপুরের জাতীয় কমিটির সদস্য ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বৈঠক হয়নি।’ দলের যখন প্রয়োজন হবে তখন বৈঠক ডাকবেন জানিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও বর্তমান পরিস্থিতিকে দায়ী করেন তিনি। দলের উপদেষ্টা পরিষদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। আওয়ামী লীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্কার হিসেবে পরিচিত এ পরিষদেরও একই অবস্থা। দলের গঠনতন্ত্রের ২৬ ধারার (ক) অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, আওয়ামী লীগের একটি কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে। এ পরিষদের সদস্য থাকবেন ৪১ জন। তবে সভাপতি প্রয়োজনে সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবেন। আওয়ামী লীগের দফতর সূত্রে জানা গেছে, এ পরিষদ এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। একই অনুচ্ছেদে বলা আছে, উপদেষ্টা পরিষদের ৩টি সেল থাকবে। ১. রাজনৈতিক ২. অর্থনৈতিক ৩. সামাজিক। ৩টি সেল থাকলেও কে কোন সেলের দায়িত্বে এবং সংশ্লিষ্ট সেলগুলো নিয়ে উদেষ্টাদের কী কার্যক্রম রয়েছে, তার পরিষ্কার কোনো চিত্র নেই। (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, উপদেষ্টা পরিষদ দলের চিন্তাকোষ বা ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ হিসেবে কাজ করবে। সেখানে আরও বলা আছে, উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের ওপর গবেষণা, মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে এবং সময়ে সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দলের বক্তব্য, বিবৃতি, মন্তব্য ও প্রকাশনা-সহায়ক তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান সরবরাহ করবে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এর কোনো কাজেই লাগানো হয়নি এ উপদেষ্টা পরিষদকে। ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে দলটিকে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের দৃশ্যত ভূমিকা চোখে পড়েনি সেই দিনগুলোয়। দীর্ঘদিন পর আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সেখানে প্রেসিডিয়ামের সদস্যরা উপস্থিত থাকেন যে কারণে প্রেসিডিয়ামের পৃথক বৈঠক ডাকা হয় না। তিনি জানান, সংকটকালে পৃথক বৈঠক প্রয়োজন হতে পারে, বিগত দিনে আমাদের তেমন সংকট সৃষ্টি হয়নি তাই সভা ডাকা হয়নি।’ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, যখন দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয় তখন উপদেষ্টাদের ডাকা হয়। আগামী ৬ সেপ্টেম্বরও বৈঠক ডাকা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপদেষ্টা পরিষদের আরেকজন প্রভাবশালী সদস্য বলেন, গঠনতন্ত্রে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। তিনি বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে কেউই সংগঠনের প্রতি বেশি মনোযোগী থাকে না। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

সর্বশেষ খবর