রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অর্থ যখন ব্যর্থ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

টাকার শক্তি বোঝাতে যুগ যুগ ধরে বেশকিছু বাক্যের ব্যবহার চলে আসছে বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে। ইংরেজিতে ‘মানি ইজ পাওয়ার’, ‘মানি ইজ সুইটার দেন হানি’ অথবা বাংলায় ‘টাকা দিলে বাঘের চোখও মিলে’, ‘টাকায় কি-না হয়’—এসব প্রবচন বেশ প্রচলিত! আর প্রচলিত এসব প্রবচনে বিশ্বাসী মীর কাসেম আলীর পরিবারের সদস্যদের ধারণা ছিল—অর্থ দিয়েই তারা মানবতাবিরোধী বিচারপ্রক্রিয়া স্তব্ধ করে দিতে পারবে। তবে তাদের সেই  ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। নানা ধরনের বাধা, প্রভাবশালী দেশের লবিস্টদের চাপসত্ত্বেও একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ফাঁসির আসামি মীর কাসেম আলীর দণ্ড বাস্তবায়ন হয়েছে। এই বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কোনো ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি অর্থ। গত পাঁচ বছর ধরে নানা ধরনের কার্যক্রম চালিয়েছে লবিস্ট গ্রুপগুলো। এমন কি রায়ের রিভিউ হওয়ার পর যখন ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি চলছিল তখন পর্যন্ত শেষ চেষ্টা চালিয়ে গেছে তারা। রিভিউয়ে মৃত্যুদণ্ড বহালের পরপরই এ দাবির কয়েকটি বিবৃতি সামনে নিয়ে এসেছেন মূল লবিস্ট ব্রিটিশ আইনজীবী ক্যাডম্যান। এর মধ্যে আছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও জাতিসংঘের বেতনভুক্ত নন এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। তারা প্রত্যেকেই শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের (ইপি) ৩৫ জন এমপির নামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লেখা একটি খোলা চিঠিও প্রচার করেছেন টবি ক্যাডম্যান। জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালাতে প্রায় তিন কোটি ডলারে যুক্তরাষ্ট্রে একটি লবিং ফার্মকে নিয়োগ করে জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলী। চুক্তি মোতাবেক ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত ওই লবিং ফার্মকে মোট দুই লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করেন তিনি। মার্কিন সিনেটের ওয়েবসাইট অনুসন্ধান করে দেখা যায়, মীর কাসেম আলী ২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল অপোজিশন’ বিষয়ে দেশটির প্রশাসনের নীতি-নির্ধারকদের কাছে লবিং করার জন্য সেখানকার একটি ফার্ম ‘ক্যাসেডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এর কাছে নিবন্ধন করেন। ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি মীর কাসেম আলীর পক্ষ থেকে লবিংয়ের জন্য ওই ফার্মকে ৮০ হাজার ডলার দেওয়া হয়। একই বছর ১৮ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় এক লাখ ডলার এবং তৃতীয় দফায় ২৩ জুন আরও এক লাখ ডলারসহ মোট দুই লাখ ৮০ হাজার ডলার পরিশোধ করা হয়। শুধু তাই নয়, বিদেশি লবিংয়ের পাশাপাশি বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদাতাদেরও নানাভাবে অর্থের প্রলোভন দেখানো হয়েছে। টাকা দিয়ে সাক্ষ্য না দিতে বিভিন্নভাবে জোর জবরদস্তি ও ভয়ও দেখানো হয়েছে বলে জানা গেছে। একাধিক সাক্ষী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের টাকা দিয়ে সাক্ষ্য না দিতে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু তারা এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। টাকা ছড়িয়ে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার বিষয়টি আদালতের পর্যবেক্ষণেও এসেছে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর গত ৬ জুন নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে মীর কাসেম আলীর লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে শুনানির সময় একটি কাগজ দাখিল করেছিলাম। আদালত বলেছেন, ‘বিচার বন্ধে ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন কী করেননি সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। তবে লবিস্টদের দেওয়া রশিদ বিবেচনায় নিয়ে বলেছেন, মীর কাসেম আলী খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং বিচারকে নষ্ট করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।’

সর্বশেষ খবর