সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

এবার তদন্ত সম্পদ নিয়ে

যুদ্ধাপরাধীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির খোঁজ নেওয়া হচ্ছে I চার দশকে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানের নীট মুনাফা দুই লাখ কোটি টাকা I আছে ব্যাংক-বীমা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল কিন্ডারগার্টেন কোচিং সেন্টার শপিং কমপ্লেক্স

নিজস্ব প্রতিবেদক

জামায়াতের শীর্ষ অর্থ জোগানদাতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার পর এবার জামায়াত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তদন্ত চালাচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। তদন্ত চলছে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের সম্পদের হিসাব নিয়েও। এরই মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এ ছাড়া নেপথ্য ভূমিকায় থাকা অর্থদাতাদের রাজনৈতিক সংশ্লেষ নিয়েও কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এমনকি চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলে যে অর্থ লেনদেন করছে, সময় সময় সে সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য যাচ্ছে সরকারের কাছে। একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, গত চার দশকে জামায়াত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিট মুনাফার পরিমাণ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। শুধু ২০১৫ সালেই প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার পরিমাণ দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, সারা দেশে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ৫৬১টি প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন এবং নেপথ্যের ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে গত বছর অক্টোবরে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৈরি করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকা সংবলিত ২১৬ পৃষ্ঠার একটি বিশদ প্রতিবেদনও তুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। বলা হয়, জঙ্গি অর্থের উৎস অনুসন্ধানের পাশাপাশি যে কোনো ধরনের লেনদেন সন্দেহজনক হলেই যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানানো হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সময় সময় সে সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

সূত্রগুলো জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর গত বছর অক্টোবর থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ছয়টি বড় ধরনের লেনদেন হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে রিপোর্ট এসেছে। ওই লেনদেনের তথ্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সরবরাহ করার বিষয়টি সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে লেখা এক চিঠিতে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনের বাইরে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ লেনদেন রয়েছে কি না সে বিষয়টি তাদের নজরদারি করা সম্ভব নয় বলেও জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠির পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন প্রক্রিয়া ও এর নেপথ্য ব্যক্তিদের কার্যক্রম আরও বেশি নজরদারির মধ্যে রাখার জন্য প্রযোজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে বলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটির এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একযোগে কাজ শুরু করেছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, জামায়াত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা শুধু জামায়াতের কার্যক্রমে ব্যবহূত হচ্ছে এমনটা নয়, এর একটা অংশ দেশে জঙ্গি কার্যক্রম বিস্তারেও ব্যয় হচ্ছে। দেশে অস্থিরতা তৈরি করে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে আরোহণের লক্ষ্যেই চার দশক ধরে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ব্যাংক, বীমা, আর্থিক খাত ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন, এমনকি গণমাধ্যমেও বিনিয়োগ রয়েছে জামায়াত রাজনীতির নেপথ্য অর্থদাতাদের। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লাসহ সারা দেশে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন জামায়াতি পৃষ্ঠপোষকরা। গোয়েন্দারা জামায়াত-সংশ্লিষ্ট যে ৫৬১টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা ছাড়াও রয়েছে আইবি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, আইবি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চিটাগং, কিং ফয়সাল ইনস্টিটিউট, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ও কমিউনিটি হাসপাতাল, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সোনারগাঁও হাউজিং, পাঞ্জেরি বাস সার্ভিস, কেয়ারি গ্রুপ, ইসলামী ব্যাংক ক্রাফট অ্যান্ড ফ্যাশন, ইসলামী ব্যাংক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ইসলামী ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইসলামী ব্যাংক ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড ডিজ্যাবল রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, রেটিনা, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ইমেজিং সেন্টার, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মসজিদ মিশন, দারুল ইহসান ট্রাস্ট, আল ইনসান ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন, জাস্টিস কনসার্ন, ইসরা ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসহারুল মুসলিমিন, রাবিতা আল আলম আল ইসলামী, আল হারামেইন ইসলামী ফাউন্ডেশন, আল ফোরকান ফাউন্ডেশন, ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশন, সার্ভেন্টস অব সাফারিং হিউম্যানিটি ইন্টারন্যাশনাল, ইসলাহুল মুসলিমিন, রিভাইভল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি, রাবেতা তৌহিদ ট্রাস্ট, বেনোভোলেন্ট ট্রাস্ট, আল হারমেইন, মিশন ডেভেলপারস, ইনটিমেট হাউজিং, সোনারগাঁ হাউজিং, কেয়ারি প্লাজা, কেয়ারি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, বিডি ফুড, ইয়ুথ গ্রুপ, মিশন গ্রুপ, আল-হামরা শপিং সেন্টার, অনাবিল, সৌদিয়া, আবাবিল, ছালছাবিল, ফুয়াদ আল খতিব মেডিকেল ট্রাস্ট, সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী, কুমিল্লার আল-আমিন একাডেমি, ইসলামী প্রি-ক্যাডেট স্কুলসহ নানা প্রতিষ্ঠান। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণার সঙ্গে মিল রয়েছে মৌলবাদ বা জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়ে কাজ করা গবেষকদের দেওয়া তথ্যের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আবুল বারকাত মৌলবাদের অর্থনীতি নিয়ে তৈরি করা তার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘মৌলবাদী অর্থনীতির বিগত চার দশকে পুঞ্জীভূত নিট মুনাফার পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা, যার ব্যাপকাংশ তারা এখন ব্যয় করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ প্রলম্বিত করতে, বিদেশি লবিস্টদের ভাড়া করার কাজে, জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে।’ এ বিষয়ে ড. আবুল বারকাত গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার হিসাবে ২০১৫ সালে তারা ২ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় বলে আসছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি-মৌলবাদীদের অর্থনৈতিক ভিত্তি খতিয়ে দেখতে হবে। তারা ওষুধ, ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো নয়টি বড় খাতে বিনিয়োগ করেছে, সেগুলো তৃতীয়পক্ষীয় অডিট করা হোক। সে ক্ষেত্রে ওদের যতগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, অথবা সেই সব প্রতিষ্ঠান, যেগুলোকে বলা হয় মুনাফাভিত্তিক নয় এবং ওদের ২৩১টি এনজিও (ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশন) আছে, এই সবগুলোর সর্বশেষ পাঁচ বছরের তৃতীয়পক্ষীয় অডিট করে বের করতে হবে, টাকা কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়। এ তথ্য বের করতে পারলে তাদের অস্ত্রের ও অর্থের উৎসমুখ বন্ধ করা যাবে। সরকার মনোযোগী হলে এটা করতে তিন থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে না।’ আর জামায়াত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অর্থ জব্দ করে সেগুলো শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধার কল্যাণে এবং দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর