শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভোগান্তির ঈদযাত্রা

যানজটে স্থবির সব রুট, কাঁচপুর পার হতেই তিন ঘণ্টা, ফেরি ঘাটে দুর্ভোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোগান্তির ঈদযাত্রা

শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি। তাই শত দুর্ভোগ পেরিয়েও বাড়ির পানে ছুটছে সবাই। রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে গতকাল তোলা ছবি —রোহেত রাজীব

মহাসড়কে মাইলের পর মাইল দীর্ঘ যানজট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের ভিতর বসে থাকা, পরিবহন সংকট, যাত্রীর চাপ, ফেরি সংকট, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যাত্রী হয়রানি—এমন সব নানা ভোগান্তির মধ্য দিয়েই শুরু হলো আনন্দের ঈদযাত্রা। রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এবং কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিল উপচে পড়া ভিড়। ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস গতকাল বিকাল থেকে বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেলস্টেশনে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে। এতে সব রুটে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ যানজট। রাজধানী থেকে উত্তর ও দক্ষিণ জনপদের দুই মহাসড়কে যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে যাত্রাপথ। এই জটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এগুলো পথে পথে নষ্ট হয়ে যানজটকে আরও তীব্র রূপ দিয়েছে। কাঁচপুর পার হতেই লাগছে তিন ঘণ্টা। ঘরে ফেরার ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিচ্ছে না নৌপথও। ফেরি ঘাটে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। এ ছাড়া লঞ্চ-ফেরিতে উপচে পড়া ভিড় এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে যে, যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সড়ক সামলানোর চেষ্টায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা ঢাকা ছাড়তে শুরু করায় গাড়ির চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কোরবানির পশুবাহী ট্রাকের মিছিল। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় যানবাহন বিকল হলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। জানা গেছে, দক্ষিণের পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাঁচপুর সেতু থেকে দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর পেন্নাই পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় সকাল থেকেই যানজট চলছে। আর উত্তরের পথে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশ থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত এলাকায় গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। এর প্রভাব পড়ছে ঢাকার বাসস্ট?্যান্ডগুলোতে। আগের রাতে ছেড়ে যাওয়া বাস সময়মতো ফিরতে না পারায় ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে গাড়ির জন?্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক গতকাল সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল পরিদর্শন করেছেন। তিনি এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে কোনো লঞ্চ চলাচল করতে দেওয়া হবে না। যাত্রী নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্নস্থান থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে ২০ কি.মি. যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। ঈদ উপলক্ষে গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়া ও মহাসড়কে যানবাহন বিকল হয়ে যাওয়া এই যানজটের অন্যতম কারণ। টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তবঙ্গের ১৬টি জেলার ৯২টি রোডসহ ১১৬টি রোডের যানবাহন এ মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করছে। দুই লেনের এই মহাসড়কে দশ গুণের বেশি যানবাহন চলছে। এ জন্য মহাসড়কে কয়েকটি পয়েন্টে টানা যানজট লেগেই থাকছে। টাঙ্গাইল পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর এশরাজুল ইসলাম গতকাল জানান, ঈদের সময় ফিটনেসবিহীন অনেক গাড়ি রাস্তায় নামার কারণে ঘন ঘন গাড়ি বিকল হয়ে পড়ছে। এতে করে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া ভোরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের করটিয়া বাইপাস এলাকায় একটি লং ভেহিকল বিকল হয়ে যায়। এ সময় গাড়ি সরাতে কিছুটা সময় লেগে যায়। মহাসড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসনে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।

গাজীপুর : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর ও এর আশপাশে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। থেমে থেমে চলছে গাড়ি। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ওই রুট ব্যবহারকারীরা। গোড়াই হাইওয়ে পুলিশ জানায়, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে মহাসড়কে গরু বোঝাই ট্রাকের সংখ্যা বেশি থাকায় এ যানজট প্রকট হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই যানজট মির্জাপুর, গোড়াই, সূত্রাপুর থেকে শুরু করে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী বিস্তৃত হয়।

নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল সকাল থেকে যানজট লক্ষ্য করা গেছে। এ দুটি মহাসড়কে দিনভর যান চলেছে একেবারে ধীরগতিতে। ট্রাফিক কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জে ভুলতা ফ্লাইওভার নির্মাণ, কাঁচপুর সেতু ও মেঘনা সেতুতে সকালে কয়েকটি যানবাহন বিকল হওয়ার কারণে যানজট প্রকট আকারে রূপ নেয়। ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দিয়ে দেশের ৩৮টি রুটে যান চলাচল করে। এর একটি পয়েন্ট হলো কাঁচপুর সেতুর পূর্ব পাড়। দুটি মহাসড়ক ওই পাড় দিয়েই বিভক্ত হয়েছে। ফলে রাজধানী ঢাকা থেকে সেতুর পূর্ব ঢাল পর্যন্ত যানবাহনের চাপ থাকে সবচেয়ে বেশি। সেতুর কয়েক কিলোমিটার পূর্বে নারায়ণগঞ্জের শিমরাইল এলাকা পর্যন্ত মহাসড়ক আট লেনের। ফলে রাজধানী হতে যানগুলো একসঙ্গে আসার পর শিমরাইল মোড়ে যানজটের শিকার হয়। কারণ শিমরাইল হতে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত সড়কটি চার লেনের। এরমধ্যে আবার শিমরাইলে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার ও যাত্রী উঠানামা হয়। তবে দুপুর ২টার পর থেকে যানবাহন চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হয়। রাতে আবার তা বেড়ে যায়।

শিমরাইল পুলিশের ট্রাফিক ইনচার্জ (টিআই) মোল্লা তাসলিম হোসেন জানান, বুধবার রাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত ৩টি গাড়ি কাঁচপুর সেতুর ওপর উঠতে গিয়ে বিকল হয়ে পড়ায় সড়কে যানজট শুরু হয়। যদিও সব সময়ের জন্য কাঁচপুর সেতুর পাশে একটি রেকার রাখা হয়েছে। কোনো যানবাহন বিকল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই রেকার দিয়ে সরানো হচ্ছে। দাউদকান্দি (কুমিল্লা) : কুমিল্লা দাউদকান্দির গৌরীপুর থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত গতকাল সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। মহাসড়কের ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ জানায়, বুধবার রাত ৩টার দিকে মেঘনা সেতুর ওপর একটি মালবাহী ট্রাক বিকল হয়ে পড়ার কারণে এই যানজটের শুরু হয়। এর পর দুই দিন ধরে থেমে থেমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী সেতু পর্যন্ত যানজট রয়েছে। দাউদকান্দির হাইওয়ে পুলিশের সার্জন মামুন জানান, ঈদুল আজহা উপলক্ষে যাত্রীবাহী বাসের মালিক পক্ষ ফিটনেসবিহীন পুরাতন গাড়িগুলো রাস্তায় নামানো ছাড়াও দুই দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে মহাসড়কের দুই পাশে কিছু কিছু স্থানে রাস্তার মাটি সরে গেছে। এ কারণে রাস্তার আকার ছোট হয়ে গেছে এবং যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই যানজটে যাত্রীবাহী বাস, রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, মালবাহী ট্রাক, কার্গো আটকা পড়ায় সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

পাটুরিয়া : ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ জনপদের সড়ক যোগাযোগের পথে গুরুত্বপূর্ণ ফেরিঘাট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় কয়েকটি ঘাট বন্ধ থাকায় দুই দিন ধরে চলছে ভয়াবহ যানজট। বিআইডব্লিউটিএর তথ?্য অনুযায়ী, বিভিন্ন স্থানে পাড় ভেঙে পড়ায় দৌলতদিয়ার চারটি ঘাটের মধ্যে মাত্র দুটি এবং পাটুরিয়ার পাঁচটি ঘাটের মধ্যে একটি বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে ঘাটে ফেরি ভিড়তেও বেশি সময় লাগছে। সূত্র জানায়, স্বাভাবিক সময়ে যেখানে এই নৌপথে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার হাজার যানবাহন পারাপার করা যায়, সেখানে গত সোমবার ২ হাজার ৭৭২টি এবং মঙ্গলবার ৩ হাজার ৪৭৮টি যানবাহন পার করা গেছে। ঈদের সময় ৮ থেকে ৯ হাজার যানবাহনের চাপ থাকে এই নৌপথে। ফেরি সংকট না থাকলেও ঘাটের সমস?্যার কারণে এবার ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, এই বাস্তবতায় লঞ্চ-ফেরিতে এত বেশি পরিমাণ যাত্রী বহন করা হচ্ছে, যার ফলে যে কোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে।

লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী নয় : পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, ওভার লোড ও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে কোনো লঞ্চ চলাচল করতে দেওয়া হবে না। যাত্রী নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তার ব্যাপারে যাত্রীদেরকেও সচেতন হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। গতকাল সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। আইজিপি বলেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় দুি্ট ধর্মীয় উৎসবের সময় যাত্রী চলাচল বেড়ে যায়। এ সময় পুলিশ তাদের গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, জানা মতে কোনো ধরনের ফিটনেসহীন লঞ্চ চলাচল করছে না। খালি চোখে সব লঞ্চ ঠিক বলেই মনে হচ্ছে। আইজিপি বলেন, ইঞ্জিনের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে কোনো লঞ্চ যদি ফিটনেসবিহীন ধরা পড়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে নৌ ম্যাজিস্ট্রেট। এর আগে তিনি লঞ্চের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। কামরুল ইসলাম নামের এক যাত্রী লঞ্চের বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, লঞ্চের নিজস্ব ও বাইরের কিছু লোক ডেকে আগে থেকে চাদর বিছিয়ে রাখে। যা পরে ওইসব লোক ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকায় ভাড়া দেন। যাত্রীদের অভিযোগ শুনে আইজিপি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসি ইব্রাহিম খানকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর