শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘জিয়া অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রদ্রোহী’

সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী নিয়ে তৃতীয় বিচারপতির রায় প্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত সায়েম সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ এবং অসাংবিধানিকভাবে দেশের রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা।

বিচারপতি সায়েম আর্মি রুলস ভঙ্গকারী সরকারি কর্মচারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের দোসর। তার চেয়ে বড় রাষ্ট্রদ্রোহী আর কে? বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জনগণের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হত্যায় সমর্থন দিয়ে হত্যাকারীদের দোসর হয়ে হত্যার দিনই প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ নেওয়ার সময় একবারও ভাবলেন না তিনি এবং তারা দেশের রাষ্ট্রপতিকে (বঙ্গবন্ধু) রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে জিয়াউর রহমান এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসন করেন। এরপরও কি তাকে এদেশের জনগণ মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারে?  উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে অর্পণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্টের যে বেঞ্চ রায় দিয়েছিলেন, সেই বেঞ্চের তৃতীয় বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের রায়ে এ মন্তব্য করা হয়েছে। ১২৫ পৃষ্ঠার এই রায়টি গতকাল সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রায়ে জিয়াউর রহমানকে আর্মি রুলস ভঙ্গকারী অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রপতি এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে উল্লেখ করেন। গত ৫ মে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেন। বেঞ্চের দুই জ্যেষ্ঠ সদস্য বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করলেও বেঞ্চের কনিষ্ঠ সদস্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রুল খারিজ করেন। এর আগে ১১ আগস্ট বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের দেওয়া ১৬৫ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশিত হয়।

বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সাংবিধানিক সংকটের কথা উল্লেখ করে রায়ে বলেন, সেই সময়কার সুপ্রিমকোর্ট অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। তার চেয়েও ভয়াবহ যখন আমরা দেখি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সায়েম অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। সংসদ ভেঙে দেন। যেখানে বিচারপতিরা সংবিধান রক্ষার শপথ নেন, সেখানে আমরা দেখলাম বিচারপতি সায়েম সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করে অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। এটি রাষ্ট্রদ্র্রোহিতা। জনগণ এসব রাষ্ট্রদ্র্রোহীদের কখনো ক্ষমা করবে না। বিচারপতি সায়েম বিচারপতির পবিত্র কলমকে বেয়নেট বানিয়ে সংবিধানকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছেন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতীয় সংসদকে তার কলমের বেয়নেটে কেটে রক্তাক্ত করেছেন। তার চেয়ে বড় রাষ্ট্রদ্র্রোহী আর কে হতে পারে? তিনি একজন জনরায় ছিনতাইকারী। তিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের দোসর। রায়ে বলা হয়, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জনগণের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হত্যায় সমর্থন দিয়ে হত্যাকারীদের দোসর হয়ে হত্যার দিনই প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করেন। পৃথিবীতে আর একটি দেশও নেই যে দেশের বিচারপতি এমন জঘন্য কাজ করেছে। বিচার বিভাগ তখন এ অসাংবিধানিক তত্পরতার বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেয়নি। রায়ে উল্লেখ করা হয়, বিচারপতি সায়েম আর্মি রুলস ভঙ্গকারী সরকারি কর্মচারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর দেশের রাষ্ট্রপতি করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তিনি (সায়েম) যেন তখন ইচ্ছা করলে একজন ডাকাতকেও দেশের রাষ্ট্রপতি বানিয়ে দিতে পারতেন। জিয়াউর রহমান বাকবাকুম করে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে নিলেন। একবারও ভাবলেন না সরকারি কর্মচারী হয়ে তিনি কীভাবে আর্মি রুলস ভঙ্গ করেন? ভাবলেন না তিনি এবং তারা দেশের রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে জিয়াউর রহমান এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসন করেন। এরপরও কি তাকে এদেশের জনগণ মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারে? রায়ে বলা হয়, আবু সাঈদ চৌধুরী, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমান গংরাসহ বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকারীদের সাহায্য সহযোগিতা ও লালন পালন করেছেন, বাঙালি জাতি তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করে এবং এদের পদ-পদবি সবকিছু প্রত্যাহার এখন সময়ের দাবি। তাই সংসদকে এমন আইন করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের জঘন্য চিন্তাও কারও মনে উদয় না হয়।

রায়ে আরও বলা হয়, অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একক ইচ্ছায় প্রণীত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবলিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংবিধান পরিপন্থী। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যবৃন্দ ও গণপরিষদের ৪০৩ সদস্যের কর্ম ও আদর্শকে অবমূল্যায়ন করার শামিল, তথা সংবিধানের প্রস্তাবনার পরিপন্থী তথা সংবিধান পরিপন্থী তথা বাতিল আইন। সংসদ কর্তৃক বিচারক অপসারণ ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যমান। অন্যদিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা কেবল পাকিস্তানে রয়েছে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন। প্রাথমিক শুনানির পর ষোড়শ সংশোধনী কেন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলের শুনানি শেষে রায় দেন হাইকোর্ট। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহার হোসেন সাজু। এ ছাড়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি। ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকলেও ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে আবার ফিরিয়ে আনা হয়।

সর্বশেষ খবর