সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
পবিত্র হজ পালিত

উগ্রবাদীদের সম্পর্কে সচেতন থাকার আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক

উগ্রবাদীদের সম্পর্কে সচেতন থাকার আহ্বান

আরাফাত ময়দানে জাবালে রহমত-এ গতকাল হাজীদের একাংশ —এএফপি

ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে নিজেকে সমর্পণ এবং নিজের ও পিতা-মাতা, সন্তান, আত্মীয়স্বজনের গুনা মাফের ফরিয়াদের মাধ্যমে গতকাল লাখ লাখ হাজী পালন করলেন পবিত্র হজ। আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ কামনায় শেষ হলো পবিত্র হজের মূল পর্ব। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক; লা শারিকা লাক’— ধ্বনিতে গতকাল ৯ জিলহজ (সৌদি আরব) মুখরিত হয়েছিল আরাফার প্রান্তর। লাখো হাজীর কণ্ঠে পুনঃপুন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির।’ হজের মূল অনুষ্ঠান মক্কার আরাফার ময়দানে অবস্থানকালে লাখো হাজী অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিলেন। মহান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ ও গুনা মাফের আকুতির পাশাপাশি উচ্চারিত হয়েছে পারস্পরিক মতপার্থক?্য ভুলে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের এক হওয়ার আহ্বান। আজ শয়তানকে পাথর মেরে পশু কোরবানি শেষে মাথা মুণ্ডন করে পবিত্র মক্কা নগরে ফিরে বায়তুল্লাহ শরিফে তাওয়াফ করবেন হাজীরা। এরপর মা হাজেরা (আ.)-এর পুণ্যস্মৃতির বরকত পাওয়ার আশায় সাফা-মারওয়া দুই পাহাড়ের মাঝে সায়ি করে আবার ফিরে আসবেন মিনায়।

আরাফার ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরায় হজের খুতবা দেন নবনিযুক্ত খতিব আবদুর রহমান আস সুদাইসি। এ সময় সদ্য অবসরে যাওয়া দৃষ্টিহীন খতিব শায়খ আবদুল আজিজকে মসজিদে নামিরার প্রথম কাতারে চেয়ারে বসা অবস্থায় খুতবা শুনতে দেখা যায়। এ সময় মক্কার গভর্নর প্রিন্স খালিদ আল-ফয়সালও ছিলেন তার পাশে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। খুতবায় পৃথিবীর নানা প্রান্তের, নানা বর্ণের লাখো মুসলিমের সমাবেশে ঐক্যের এই আহ্বান জানানো হয়। খুতবায় মসজিদুল হারামের এই খতিব আইএসের মতো উগ্র গোষ্ঠীকে নিয়ে মুসলিম দেশগুলোর সমস?্যার মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ইরানের বর্জনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, হজের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ না করতে এবং গুজব না ছড়াতেও সংবাদমাধ?্যমকে পরামর্শ দেন তিনি। আইএসের মতো ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আস সুদাইসি বলেন, সন্ত্রাসবাদীদের কোনো ধর্ম নেই, কোনো দেশ নেই। সন্ত্রাসবাদীরা যেন তরুণদের বিভ্রান্ত করতে না পারে, সেজন?্য মুসলিম পণ্ডিত, ধর্মীয় নেতা থেকে শুরু করে পরিবারপ্রধানদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয় খুতবায়। খুতবায় আরও বলা হয়, নিজেদের মধ্যে যে সমস?্যাগুলো রয়েছে, তার সমাধান করতে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের এক হতে হবে। তিনি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অন্যায় ও অনাচার, মন্দ কথা, গালি-গালাজ থেকে বিরত থাকার তাগিদ দেন। মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়ে বিশ্বনবীর পথে ও মতে চলার আহ্বান জানান। মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনায় দীর্ঘ মোনাজাত করেন। হজ কবুল ও সবাইকে নিষ্পাপ হিসেবে কবুল করার জন্য দোয়া করেন। এ সময় সবার চোখের কোণ গড়িয়ে পড়ছিল পানি। হজের খুতবা শেষে আরাফার ময়দানে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করেন হাজীরা। হিজরি ১০ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) এই হজের দিনে আরাফার ময়দানে সমবেত হাজীদের উদ্দেশে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে শেষ খুতবা দিয়েছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, আজ থেকে ইসলামকে পরিপূর্ণ ধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালার কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম।

আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য সারা দিন আরাফার ময়দানে হাজিরা দেওয়ার মাধ্যমে হজের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন হাজীরা। আজ শয়তানকে পাথর মেরে পশু কোরবানি শেষে মাথা মুণ্ডন করে পবিত্র মক্কা নগরে ফিরে গিয়ে বায়তুল্লাহ শরিফে তাওয়াফ জিয়ারত এবং মা হাজেরা (আ.)-এর পুণ্যস্মৃতির বরকত পাওয়ার আশায় সাফা-মারওয়া দুই পাহাড়ের মাঝে সায়ি করে ফিরে আসবেন মিনায়। গতকাল সূর্যাস্তের পর হাজীরা আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফায় যান। মুজদালিফায় নিয়ম মোতাবেক মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করেন। রাতে মুজদালিফায় অবস্থানের সময় শয়তানকে মারার জন্য ৪৯টি ছোট আকারের পাথর সংগ্রহ করেন। আজ ১০ জিলহজ (সৌদি আরবে) সূর্যোদয়ের পর হাজীরা মিনায় ফিরে আসবেন। মিনায় ফিরে তারা সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার আগে জামারাতে আক্কাবায় (বড় শয়তানকে) গিয়ে সাতটি কঙ্কর ছুড়বেন। শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নির্দেশে হজরত ইসমাইল (আ.) যেভাবে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন, তার অনুসরণে এই পাথর ছুড়ে মারা হয়। এরপর হাজীরা পর্যায়ক্রমে পশু কোরবানি দেবেন। আজকের দিনে সবচেয়ে বড় ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজ নিজ সাধ্যমতো পশু কোরবানি দেওয়া। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নিজ পুত্রকে উৎসর্গ করার আত্মত্যাগের ইচ্ছাকে কবুল করে মহান রাব্বুল আলামিন মুসলমানদের জন্য মহিমান্বিত এই কোরবানি বিধান নাজিল করেছেন। কোরবানি শেষে পুরুষ হাজীরা মাথা মুণ্ডাবেন এবং মক্কায় ফিরে গিয়ে কাবাঘর তাওয়াফে জিয়ারত এবং ‘সাফা ও মারওয়া’ দুই পাহাড়ের মাঝে সাতবার সায়ি করবেন। এরপর ইহরাম খুলে ফেলবেন এবং মিনায় নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। এরপর হাজীরা ১১ জিলহজ মাঝারি শয়তানকে এবং ১২ জিলহজ ছোট শয়তানকে উদ্দেশ করে সাতটি করে কঙ্কর ছুড়ে মারবেন। কঙ্কর ছোড়ার মাধ্যমে হাজীরা শয়তানের প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকার শপথ নেন। হজ পালনের আগে বা পরে হাজীরা আল্লাহর প্রিয় হাবিব রসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করার জন্য মদিনা শরিফ সফর করে থাকেন। আগামী ৮ অক্টোবর শুরু হবে বাংলাদেশের হাজীদের ফিরতি হজ ফ্লাইট। ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।

সর্বশেষ খবর