রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেপরোয়া এমপিপুত্র

মনিরুল ইসলাম মনি, সাতক্ষীরা

বেপরোয়া এমপিপুত্র

দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন সংসদ সদস্য রিফাত আমিনের ছেলে রাশেদ সরোয়ার রুমন। তার ঘটনাবলিই এখন সাতক্ষীরা শহরের এখানে সেখানে আলোচ্য বিষয়। অতীতে বিভিন্ন অপরাধে জড়ানো রুমন ঈদুল আজহার ছুটির আগে-পরে জড়িয়েছেন সিরিজ ক্রাইমে। কখনো মাতলামি, কখনো কমান্ডো স্টাইলে বাহিনী নিয়ে দলীয় নেতাদের মারধর, কখনো আবার চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে অন্যের বাড়িতে জোরপূর্বক ঢুকে সম্পদ লুণ্ঠন, কখনো নারী নিয়ে ফুর্তি করার সময় গণধোলাই— এসব ঘিরেই তিনি এখন সাতক্ষীরা শহরে ‘হট টপিক’। এ ছাড়া তার অত্যাচারে শহরবাসী অতিষ্ঠ। তবে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, পুলিশ প্রশাসনের নীরবতা আর এমপি মায়ের আশকারা পেয়ে রাশেদ সরোয়ার রুমনের ভঙ্গি হয়েছে— ‘রুখবে আমারে কে!’ পুলিশ রুমনকে ‘পলাতক’ উল্লেখ করে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে। অথচ সাতক্ষীরা সদর থানার বিপরীতে মাত্র ১০ হাত দূরেই রুমনের বাড়ি নিয়মিত যাতায়াত করছেন রুমন। কিন্তু পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।

আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মী ও সরেজমিন  স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরা এলজিইডির টেন্ডার কব্জায় নিয়ে অর্জিত কয়েক লাখ টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা পৌরসভা চত্বরে জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগ সদস্য জুলফিকার রহমান উজ্জ্বলকে লোহার রড ও হাতুড়ি দিয়ে পেটান রুমন ও তার সহযোগীরা। হামলা ঠেকাতে গিয়ে আহত হন উজ্জ্বলের সহযোগী মিলন, কালাম, ফারুক, সালামসহ কয়েকজন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা হলেও পুলিশ রুমন বা তার কোনো সহযোগীকে গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার করেনি। মারধরের ওই ঘটনার ঠিক ঘণ্টাখানেক পরে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় একটি মিনি পাজেরো চালিয়ে ভোমরা স্থলবন্দরের দিকে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পতিত হন রুমন। এতে তিনি অক্ষত থাকলেও গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। বিধ্বস্ত অবস্থায় গাড়িটি ফেলে তিনি আরেকটি গাড়ি নিয়ে চলে আসেন শহরতলির মাগুরায় ব্যবসায়ী মিলন পালের বাগানবাড়ি। মিলন পাল সোনা চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিত। তার বাগানবাড়িতে এক নারীকে নিয়ে রাত কাটানোর পর ঈদের আগের দিন সকালে রুমনের অবস্থান জানাজানি হলে যুবলীগ নেতাকে মারধরের প্রতিশোধ নিতে গ্রামবাসী তাকে ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে জেলা যুবলীগ সভাপতি আবদুল মান্নান, অ্যাডভোকেট তামিম আহমেদ সোহাগ ও পৌর যুবলীগ আহ্বায়ক মনোয়ার হোসেন অনু তাকে উদ্ধার করতে যান। এ সময় গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হন এমপিপুত্র রুমন ও তার প্রেমিকা। পরে ঈদের আগের রাত ৮টার দিকে রুমন নিজে ও তার মা মিসেস রিফাত আমিন এমপি মিলন পালের তালাবদ্ধ বাগানবাড়িতে ঢোকার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে গেট ভাঙচুর করেন।

পরদিন মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে সবাই যখন ঈদের নামাজ নিয়ে ব্যস্ত তখন রুমন নিজস্ব বাহিনী নিয়ে এসপি ও ওসির নাম ভাঙিয়ে হামলে পড়েন মিলন পালের বাগানবাড়িতে। তারা তালা ভেঙে গেট খুলে বাড়িতে রাখা এমপির লাইসেন্সকৃত একটি পিস্তল বের করে আনেন। পিস্তলটি রবিবার রাতে ভোমরা দুর্ঘটনার পর বাগানবাড়িতে নিয়ে রেখেছিলেন রুমন। এর আগে রুমনের স্ত্রী বেলী মিলনের লক করা প্রাইভেট কারের গ্লাস ভেঙে ভিতর থেকে টাকা নিয়ে যান। এ ছাড়া কয়েক দিনের ব্যবধানে মিলন পালের বাড়ির খামারের ১৩টি বিদেশি উন্নত জাতের মূল্যবান গরু লুট করেন রুমন। এমনকি কারাগারে আটক মিলনকে ছাড়াতে এর আগে ২০ লাখ টাকাও নিয়েছেন রুমন। মিলনের স্ত্রী শম্পা রানী পাল জানান, ‘মিলন পাল ১৬ কেজি সোনা চোরাচালান মামলায় জেলে আটক রয়েছেন। এই সুযোগে তার সম্পদ লুটপাটের পাঁয়তারা করছেন রুমন।’ পরে ঈদের দিন রুমন তার এক বন্ধুকে পাঠান সাতক্ষীরার কারাফটকে। সেখানে সাক্ষাতের নামে বন্দী মিলন পালের কাছ থেকে ২৫০ টাকার সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরের জন্য জবরদস্তি করেন রুমনের বন্ধু। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আসায় ‘কাজ’ হয়নি।

কারাগারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘এ ঘটনার কয়েক দিন আগে সই নেওয়ার জন্য রুমন এসে কয়েক ঘণ্টা ধরে কারাফটকে চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু আইনানুযায়ী এভাবে আদালতের অনুমোদন ছাড়া স্বাক্ষর সম্ভব নয় বিবেচনায় সেদিন তাদের স্বাক্ষর নিতে দেওয়া হয়নি। এরপর ঈদের দিন কারাগারে কম উপস্থিতির সুযোগে চুপিসারে স্বাক্ষরের চেষ্টা চালান রুমনের পাঠানো লোকজন।’

স্থানীয়দের তথ্যমতে, এখন মিলন পালের বাগানবাড়ি ও সম্পদ দখলের চেষ্টা করছেন রুমন। অথচ আড়াই মাস আগেও এই সোনা চোরাকারবারির পক্ষেই কাজ করেছেন রুমন। সে সময় মিলন পালের পক্ষ নিয়ে সাহেব আলী নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করেন। এর কিছুদিন আগে তার মায়ের ব্যবহৃত জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়িসহ শ্যামনগরের বর্ষা রিসোর্টের ১০৪ নম্বর রুমে একই সঙ্গে তিন তরুণীকে নিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় শ্যামনগর থানার পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পুলিশ ওই সময় সেই রুম থেকে এমপির ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও ২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। জব্দ করা হয় জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়িটিও। এ সময় ছেলে রুমনকে ছাড়াতে এমপি মা রিফাত আমিন নিজেই চলে যান পুলিশের কাছে। অভিযোগ আছে যে, ওখানে পুলিশকে ধমকিয়ে চাপ সৃষ্টি করায় পুলিশ নামমাত্র মোটরযান আইনে একটি মামলা দিয়ে তাকে জেলহাজতে পাঠায়। এরপর বেশ কিছুদিন জেল খেটে সম্প্রতি মুক্তির পর ফের শুরু করেছেন নানান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে টেন্ডারবাজি।

সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘রুমনের বিরুদ্ধে যুবলীগ নেতাসহ কয়েকজনকে হত্যাচেষ্টায় মারধরের মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

রিফাত আমিন এমপি বলেন, ‘আমার ছেলে কোথাও যায়নি, সবই অপপ্রচার। আওয়ামী লীগের কিছু লোক ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার ও রুমনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে তাদের সাইজ করার ব্যবস্থা করে দেব।’

রাশেদ সরোয়ার রুমন বলেন, ‘আমি কোনো অঘটন ঘটাইনি।’ মিলন পালকে ছাড়াতে তিনি ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে তাও সত্য নয় বলে দাবি রুমনের।

সর্বশেষ খবর