রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
জিএফ কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী

নারী নির্যাতনে জিরো টলারেন্সে বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরাতে ঐকমত্য, বাবার মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা গ্রহণ করলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী

প্রতিদিন ডেস্ক

নারী নির্যাতনে জিরো টলারেন্সে বাংলাদেশ

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর হাতে তার বাবা পিয়েরে অ্যালিওট ট্রুডোর মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —এএফপি

কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত ফিফ্থ গ্লোবাল ফান্ড (জিএফ) রিপ্লেনিশমেন্ট কনফারেন্সের উদ্বোধনী অধিবেশনে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ নারীর বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের সহিংসতা ও বঞ্চনার ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে রয়েছে। তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠকের সময় তার হাতে তার বাবা পিয়েরে অ্যালিওট ট্রুডোর মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ হস্তান্তর করেছেন।

এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীর বহিঃসমর্পণের উপায় বের করার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ও কানাডা। বৈঠকে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতেও দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

বাসস জানিয়েছে, জিএফ কনফারেন্সে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সল, টোগোর প্রেসিডেন্ট ফুয়ারে গ্রেনসিভ, গ্লোবাল তহবিলের নির্বাহী পরিচালক মার্ক আর দাইবাল ও আন্তর্জাতিক সংস্থা লা ফ্রাঙ্কোফনির মহাসচিব মিখায়েল জেন সম্মেলনে বক্তব্য দেন। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং লা ফ্রাঙ্কোফনির বিষয়ক কানাডীয় মন্ত্রী ম্যারেই ক্লদি বিবেউ অধিবেশন পরিচালনা করেন।

কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক তিনটি সংক্রমণ ব্যাধি এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে একত্রে কাজ করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি ভাষণে বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধযোগ্য ও এসব রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। একত্রে কাজ করার মাধ্যমে এই ব্যাধির অবসান ঘটাতে পারে।’ তিনি বাংলাদেশের সব জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তার সরকারের প্রচেষ্টায় বৈশ্বিক তহবিলের সহযোগিতা চেয়ে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অবকাঠামো, স্বাস্থ্যপণ্য ও সেবায় বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে আমার সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। আমাদের প্রচেষ্টায় আমরা বৈশ্বিক তহবিলের সহায়তা আশা করছি।’ উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ দিক’ হিসেবে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সমাজের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব আজ উন্নয়ন প্রত্যাশার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দারিদ্র্যমুক্ত সবল একটি বিশ্ব সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০১৫ সালে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। সক্ষমতা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত লক্ষ্যসমূহসহ এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতে বালিকা ও নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে তার সরকারের অঙ্গীকার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনটি বিষয় চিহ্নিত করে বলেন, ‘সরকার নারীর ক্ষমতায়নের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে। আমরা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের উপবৃত্তি চালু করেছি। এর ফলে তাদের স্কুলে উপস্থিতির হারই শুধু উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, এইসঙ্গে নাবালিকা বিয়ে এবং মা ও শিশু মৃত্যুহারও হ্রাস পেয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, সহিংসতার ফলে নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। তাই আমরা নারীর বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের সহিংসতা ও বঞ্চনার ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি। তৃতীয়ত, সরকার দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৬ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছে। এই ক্লিনিকগুলোর কর্মীর অধিকাংশই নারী এবং এসব কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত শক্তিশালীকরণে গ্লোবাল ফান্ডসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, গ্লোবাল ফান্ড বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে যা মূলত ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও এইচআইভি আক্রান্তদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করছে।

এর আগে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণদানের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে উপস্থাপক এবং কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও ফ্রাঙ্কোফনি বিষয়ক মন্ত্রী মেরির ক্লদ বিবে বলেন, শেখ হাসিনাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই ‘তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্তম্ভ’।

মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা হস্তান্তর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে অ্যালিওট ট্রুডোকে মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় সময় শুক্রবার মন্ট্রিলে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে পিয়েরে ট্রুডোর ছেলে ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কাছে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’ হস্তান্তর করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও এতে বিশেষ অবদান রাখায় কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোকে বাংলাদেশ সরকার এই সম্মাননা প্রদান করে। এ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও অটোয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জানান, সম্মাননা প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে কয়েকজন বিশ্বনেতা পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন পিয়েরে ট্রুডো তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কয়েকটি দেশ প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তার মধ্যে কানাডা অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিয়েরে ট্রুডো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ পক্ষে দৃঢ়ভাবে কথা বলেছেন। এ অনুষ্ঠানে জাস্টিন ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘আমরা উভয়ে সেকেন্ড জেনারেশন। আপনার পিতা ও আমার পিতা উভয়েই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।’ শেখ হাসিনা কানাডার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

নূর চৌধুরীর বিষয়ে মতৈক্য : আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীর বহিঃসমর্পণের উপায় বের করার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ও কানাডা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর চৌধুরী কানাডায় পালিয়ে রয়েছেন। হায়াত রিজেন্সি মন্ট্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ ব্যাপারে মতৈক্য হয়।

বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহ্সানুল করিম সংবাদিকদের ব্রিফ করেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দেশের কর্মকর্তারা বৈঠকে মিলিত হয়ে নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিঃসমর্পণের উপায় বের করবেন। আলোচনার লক্ষ্য হবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরের জন্য নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনা।’ তিনি আরও জানান, সরকার বিভিন্নভাবে নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার বহিঃসমর্পণের ব্যাপারে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। তিনি আরও বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ইস্যুকে দুই নেতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জঙ্গিবিরোধী অবস্থান এবং জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ ও গার্মেন্টস পণ্যের রপ্তানির মতো অন্যান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সফরের জন্য জাস্টিন ট্রুডোকে আমন্ত্রণ জানান। কানাডার প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকতার সঙ্গে তার এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা যোগ হলো।

সর্বশেষ খবর