বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইয়াবা নারীর ভয়ঙ্কর সাম্রাজ্য

সাঈদুর রহমান রিমন

ইয়াবা নারীর ভয়ঙ্কর সাম্রাজ্য

রাজধানীতে নামিদামি মডেলসহ দেড় শতাধিক তরুণী, দুই ডজনেরও বেশি আফ্রিকান নিগ্রো ও সাসপেন্ড অবস্থায় থাকা অন্তত ১০ জন পুলিশ সদস্যের সমন্বয়ে ‘ইয়াবা ও নারী’ বাণিজ্যের বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। এ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে আছেন পেশাদার সন্ত্রাসী, বহু মামলার আসামি ফয়সাল ইসলাম রাসেল ওরফে ভাতিজা রাসেল। প্রতিদিন তার নিয়ন্ত্রিত রামপুরা-বনশ্রী, নিকেতন, বনানী, গুলশান, বারিধারা, নিকুঞ্জ ও উত্তরার এলাকাতেই আট সহস াধিক ইয়াবার সরবরাহ যায়। জানা যায়, এ থেকে প্রশাসন ম্যানেজসহ সিন্ডিকেটের যাবতীয় খরচ মিটিয়েও দৈনিক দুই লক্ষাধিক টাকা রাসেলের পকেটস্থ হয়।

রাসেলের ঘনিষ্ঠ অপরাধ সহযোগীসহ ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, অভিজাত পরিবারের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেক তরুণীকে নগ্ন ভিডিওর ফাঁদে জিম্মি করে আলাদা ইয়াবা বাজার গড়ে তুলেছে ওই সিন্ডিকেট। এসব মেয়েদের ব্যবহার করে প্রতি সপ্তাহেই টেকনাফ সীমান্ত থেকে ইয়াবার বড় বড় চালানও আনা হচ্ছে ঢাকায়। শিক্ষিত, স্মার্ট তরুণীদের সাইনবোর্ড বানিয়ে নামিদামি ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানসহ বিত্তবান ইয়াবাসেবীদের আসরও বসাচ্ছেন তিনি। প্রতি রাতেই দেশি-বিদেশি ভিআইপি গেস্ট আর বাছাইকৃত তরুণীদের নিয়ে ডিজে পার্টির আদলে কথিত আনন্দ আয়োজনের নামে চলে বেলেল্লাপনা।

গত শনিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘যাচ্ছে নারী-আসছে ইয়াবা’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই ভাতিজা রাসেলের ইয়াবা সাম্রাজ্যের ভয়াবহ কাহিনী বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সিন্ডিকেটের নানামুখী প্রতারণায় জিম্মিদশাগ্রস্ত নারীদের অনেকেই নিজেদের সর্বনাশের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন। রাসেল চক্রের নগ্ন ভিডিওর ফাঁদে ইয়াবার জালে আটকে পড়া স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের দিশাহারা পরিস্থিতি বলতে গিয়ে অনেক অভিভাবক কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা রাসেলের হেফাজতে থাকা আপত্তিকর ভিডিওচিত্রগুলো উদ্ধার করে এসব মেয়েদের রক্ষার দাবি জানান। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, আড্ডাবাজি ও টুকটাক ইয়াবা সেবনের দৃশ্যাবলি ভিডিও করে তা দেখিয়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীদের দুর্বল বানিয়ে নিজস্ব কব্জায় নেয় রাসেল। পরবর্তীতে যে কোনো আনুষ্ঠানিকতার উছিলায়  রাসেলের নিজস্ব আস্তানায় নিয়ে নানা নগ্নতার ভিডিও করা হয়। বারিধারার দুটি আবাসিক হোটেল, দেহ বাণিজ্যের তিনটি ফ্ল্যাট বাড়ি, গুলশানের দুটি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের তিনটি দেহ বাণিজ্যের ফ্ল্যাটকে রাসেল চক্র নিজেদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। রাসেলের অপরাধ অপকর্মের দীর্ঘদিনের সাথী এক যুবক জানান, নগ্ন ভিডিওর অপকর্ম থেকে শুধু মেয়েরাই নয়, তার টার্গেটকৃত পুরুষরাও রেহাই পায় না। স্বেচ্ছায় নগ্নতায় রাজি না হওয়া পুরুষ-নারীদের কৌশলে নিজস্ব আস্তানায় ঢুকিয়েই বেধড়ক পেটানো হয়। পিটিয়ে অনেকের হাত, পা ভেঙে দেওয়ারও নজির রয়েছে। মাস তিনেক আগে বনানীতে এক ধনাঢ্য যুবককে পাঁচ লাখ টাকার দাবিতে আটক করে রাসেল এতটাই বর্বরতা চালায় যে, ওই যুবক ঘরের মধ্যে প্রস াব-পায়খানা পর্যন্ত করে ফেলে। রাসেলের নির্দেশে সেগুলো তাকে গিলতে বাধ্যও করা হয়। এমন নির্যাতনের মুখে ভীতসন্ত্রস্ত নারী-পুরুষ রাসেলের নির্দেশের ক্রীড়নক হয়ে পড়ে এবং তার ইচ্ছে অনুযায়ী নগ্নতার নানা দৃশ্যে বন্দী হয়ে পড়ে। রাসেলের নানা অপরাধের সহযোগী ওই যুবক আরও জানান, গত তিন বছরেই গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি, নিকেতন, নিকুঞ্জ ও উত্তরার দেড় শতাধিক নারী এমন ভিডিও আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে বড় অংশই হচ্ছে শিক্ষার্থী। এখন তারা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রাসেলের সব ধরনের নির্দেশনা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ইয়াবা সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠা ফয়সাল ইসলাম রাসেল ওরফে ভাতিজা রাসেল ২০০০ সাল থেকেই অস্ত্র, গোলাগুলি, খুন-খারাবির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আলোচিত মুরগি মিলন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রাসেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানাতেই অস্ত্র আইনে, গাড়ি চুরি, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ও হত্যা চেষ্টা সংক্রান্ত অন্তত ১৩টি মামলা রয়েছে। ধানমন্ডি থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে গ্যাং রেপ কেস। কাফরুল থানার একটি অস্ত্র আইনের মামলায় আরও পাঁচ বছর আগেই ফয়সাল ইসলাম রাসেলের ১৪ বছর কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত। অন্য ১১টি মামলায় তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি থাকলেও পুলিশ নাকি তাকে খুঁজেই পায় না। অথচ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব বজায় রেখেই রাসেল বছরের পর বছর ধরে ইয়াবা সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলছে।

রাসেলের উত্থান : মিয়ানমারের ইয়াবার বাংলাদেশে ব্যাপকভিত্তিক বাজার তৈরি হওয়ার আগেই রাসেল জনৈক ‘ইয়াবা জুয়েলের’ হাত ধরে ইয়াবা বাণিজ্যে নেমে পড়ে। পরবর্তীতে সে আমিন হুদারও ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠে। সে সময় ব্যাংকক থেকে বিমানযোগে লাগেজ পার্টির সদস্যরা এসব ইয়াবা এনে গুলশান-বনানীর অভিজাত রেস্তোরাঁ ও বারে সরবরাহ দিত। রাসেল সেই ইয়াবার মগবাজার, মৌচাক, ইস্কাটন, পল্টন, রমনা এলাকায় বেচাকেনার দায়িত্ব পালন করত। মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ এলাকার সব আবাসিক হোটেলের নিয়ন্ত্রণ করত রাসেল। এসব হোটেলে নারী বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ছিল। হোটেলে পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত মেয়েদের কক্সবাজার টেকনাফ পাঠিয়ে ইয়াবা আমদানির ব্যবস্থা চালু করে রাসেল। শ্যামবর্ণ, কোঁকড়া চুল, খাটো, স্বাস্থ্যবান রাসেলকে দেখলে যে কারোর মনে হবে দূর গ্রামের আনাড়ি কোনো মানুষ। কিন্তু ধূর্ত ওই ব্যক্তি ঠাণ্ডা মাথার কিলার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মস্থান হলেও বারিধারার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকার ২১ নম্বর রোডের বাসিন্দা। একদা ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। এসএসসির পর সে সিদ্ধেশ্বরী কলেজে এসে ভর্তি হন। দিনে দিনে তার স্খলন এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে স্বজন-পরিজনের কাছেও তার পাত্তা নেই। নিজের সৎ বোন স্মৃতিকে বিয়ে করে বনশ্রী এলাকায় ভাড়া বাসায় রাখে। সেখানে দেহ বাণিজ্য ও ইয়াবা বাণিজ্য চলে দেদারছে। অভিজাত পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে উঁচুপর্যায়ে যাতায়াত রপ্ত করে রাসেল। গাড়ির প্রতি বিশেষ নেশায় রাসেল যে কারও পছন্দসই গাড়ি দেখলেই ছলেবলে কলে কৌশলে গাড়িটি কব্জা করে নেয়। নারীর প্রতি দুর্বলতা থেকেই রাসেল একের পর এক বন্ধুর সংসার ভেঙে তাদের স্ত্রী, বোন, মা-খালাদের পর্যন্ত নানাভাবে ব্যবহার করে। নিত্যনতুন মেয়েদের ভোগ করতে একেক সময় একেক বাসা ব্যবহার করে। নিজের পরিচালনায় মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে ও আদাবরের ৬ নম্বর রোডে দেহ বাণিজ্য চালান। গুলশান নিকেতনে তার আছে তিনটি ফ্ল্যাট, উত্তরাতেও আছে দুটি ফ্ল্যাট।

অভিযোগ গুরুতর! : রাজধানীর সবচেয়ে বৃহৎ ইয়াবা সিন্ডিকেটের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম সচল রাখছেন নানা অপরাধে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া সাব-ইন্সপেক্টর ও সহকারী সাব-ইন্সপেক্টরদের বেশ কয়েকজন। জানা যায়, তারা রাজধানীর একস্থান থেকে অন্যস্থানে ইয়াবা বহন করে পৌঁছে দেন এবং কেউ কেউ পাইকারিভাবে ক্রয়-বিক্রয়ও করে থাকেন। সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় অনেকটা হতাশার বেড়াজালে আটকে পড়া এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের ইয়াবা নেটওয়ার্কে কৌশলে ভেড়ানো হয়। তারা রাস্তাঘাটে পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়ে তল্লাশির বাইরে থাকায় ইয়াবার চালানগুলো নির্বিঘ্নে পৌঁছানো সম্ভব হয়। তাছাড়া ইয়াবা সিন্ডিকেটের কোনো ব্যবসায়ী কোথায়ও গ্রেফতার হলে তদবির কর্মকাণ্ডেও এসব পুলিশ কর্মকর্তার অগ্রণী ভূমিকা থাকে। এসব কাজের বিনিময়ে একেকজন দৈনিক চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা পেয়ে থাকেন বলেও জানা গেছে। রাসেলের সিন্ডিকেটে এ ধরনের অন্তত ১০ জন পুলিশ কর্মকর্তা গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর