প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত কোম্পানি যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই— অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এমন বক্তব্যের পর এখন এই প্রতিষ্ঠানটির সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্পদের দায়িত্ব কে নেবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা বলছেন, তারা এখনো সরকারের দিকে চেয়ে আছেন। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বলছে, যুবক-এর যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা দিয়ে গ্রাহকদের দাবি মেটানো সম্ভব নয়। ফলে যেচে সরকার এই সম্পদের দায় নেবে না। ২০১০ সালে তখনকার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে যুবক বিষয়ে যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল, সেই কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে যুবক। বিপুল পরিমাণ ওই অর্থ নেওয়া হয় ৩ লাখ ৩ হাজার ৭০০ গ্রাহকের কাছ থেকে। এ অর্থ গ্রাহককে ফেরত দিতে ওইসব স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য ২০১৩ সালে যুবকে প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করেছিল সাবেক যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন যুবকবিষয়ক সরকারের কমিশন। এরপর থেকেই প্রশাসক নিয়োগে চিঠি চালাচালি ও একের পর এক সভা করে আসছে অর্থ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ সভাটি হয়েছে গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে। ওই সভা শেষে অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দেন, যুবক-এ যারা বিনিয়োগ করেছিলেন, পাওনা আদায়ে তাদের কেউ এ পর্যন্ত একটা মামলাও করেনি। এ বিষয়ে সরকারের নতুন করে আর কিছু করার নেই।
কী পরিমাণ সম্পদ আছে যুবক-এর : অর্থমন্ত্রী বুধবারের বৈঠকে জানিয়েছেন, যুবক-এর নামে সারা দেশে প্রায় ৯৮ একর সম্পত্তি রয়েছে। অবশ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই সম্পত্তির পরিমাণ আরও বেশি হবে। আর যুবক বিষয়ে সরকার গঠিত কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠানটির ৯১ খণ্ড জমি, ১৮টি বাড়ি ও ১৮টি কোম্পানি রয়েছে। এসব সম্পত্তি নিয়ে নানা ধরনের জটিলতাও রয়েছে। কোনোটার বায়না হয়েছে রেজিস্ট্রেশন হয়নি। কোনোটার আবার রেজিস্ট্রেশন হলেও মালিকানা স্বত্ব দাখিল করা হয়নি। কিছু কিছু সম্পদ বেদখল হয়ে আছে। আবার কোথাও কোথাও গোপনে জমি বা বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুবকের কাছে বরিশাল বিভাগে ৪০০ কোটি টাকা, চট্টগ্রামে ৮০০ কোটি টাকা ও ঢাকার গ্রাহকদের মোট পাওনা হচ্ছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই পাওনার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির নামে ব্যাংকের নগদ টাকা খুব একটা পাওয়া যায়নি। ৪৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে মাত্র ৭৮ লাখ টাকার সন্ধান পায় কমিশন। আর স্থাবর সম্পত্তির যে সন্ধান পাওয়া গেছে গ্রাহকের দায়ের তুলনায় তা সামান্য। অবশ্য যুবকে ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটির নেতারা জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৬২ হাজার ৩৪৮ শতাংশ পরিমাণ স্থাবর সম্পদ (জমি, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট) রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর ৫৪, পুরানা পল্টনে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ নির্মাণাধীন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন বিকে টাওয়ার (বর্তমানে কাজ বন্ধ), ৫৩/১ পুরানা পল্টনে ২১ দশমিক ৫ শতাংশের বাড়ি (ভাড়া দেওয়া), ধানমন্ডিতে ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশের একটি বাড়ি; ৪০০, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশের শিল্পপ্লট (ভাড়া দেওয়া), কাঁচপুরে ৮৭৮ শতাংশের শিল্পপ্লট, চট্টগ্রামে খুলশীতে অ্যাপার্টমেন্ট, খুলনা সদরে ৩৩ শতাংশের বাড়ি, বরিশালের শায়েস্তাবাদে ৪১ শতাংশের বাড়ি, ফেনীতে ৩৬ শতাংশের অ্যাপার্টমেন্ট, চাঁদপুরে ৩০ শতাংশের বাড়ি, পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ৫৯৯ শতাংশ জমি ও বাড়ি এবং সেন্ট মার্টিনে ৭৬৯ শতাংশ জমি রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দরের পাশে প্রায় ৪০ বিঘা, সাভার মডেল টাউন এক ও দুই নম্বর, মাদারীপুর চক্ষু হাসপাতালের সামনেও সম্পত্তি রয়েছে। চট্টগ্রাম মেঘনা সি ফুড মিল এবং মাদারীপুর, পিরোজপুরসহ সারা দেশের ১৯টি জেলায় প্রতিষ্ঠানটির জমির সন্ধান পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় আবাসন প্রকল্পের নামে জমি রয়েছে যুবক-এর। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরায় মিতালী প্রকল্পে ৬০০ দশমিক ৮ শতাংশ, মিতালী স্যাটে-১ প্রকল্পে ১১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মিতালী স্যাটে-২ প্রকল্পে ১১৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ জমি রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার পাশে যুবক সিটির নামে কুমারখোদা, সাভারে ৬ হাজার ৯০ শতাংশ, সাভার প্রকল্প-১ (ফোটনগর, ধামরাই) ৪ হাজার ৬৪৭ শতাংশ, সাভার প্রকল্প-২ (কুশিয়ারা, ধামরাই) ৩২ হাজার ৮১২ শতাংশ, কেরানীগঞ্জ প্রকল্প-১ (বাঘের) ২ হাজার ১১ শতাংশ, কেরানীগঞ্জ প্রকল্প-২ (পশ্চিমদি) ২৯০ শতাংশ, ধলেশ্বর প্রকল্প (আবদুল্লাহপুর, কেরানীগঞ্জ) ১ হাজার ৯১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জ প্রকল্প (জালকুড়ি) ৯৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ, মুন্সীগঞ্জ প্রকল্প-২ (মুন্সিরহাট) ৬৮৫ শতাংশ, মানিকগঞ্জ প্রকল্প (আরিচা রোড) নামে ২৬০ শতাংশ জমি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। যুবক গ্রাহকদের স্বার্থে করা সংগঠন যুবক ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন মুকুল বলেন, উচ্চমূল্যের এসব জমি ও বাড়ির সব সম্পদ এখন যুবক কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গোপনে ধানমন্ডির বাড়িটি বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু বাড়ি রয়েছে দখলদার ও ভাড়াটেদের হাতে। তেজগাঁও ঠিকানায় সাড়ে ৪৯ শতক জমি ঢাকা ব্যাংকে বন্ধক রেখে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। ওই টাকা দিয়ে টেলিবার্তা প্রকল্প হাতে নেয় যুবক। পরে টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। ওই সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে। আরও কিছু সম্পত্তি গোপনে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে যুবক-এর শীর্ষ কর্মকর্তারা। সরকার এসব সম্পদ নিজের তত্ত্বাবধানে না নিলে সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হবে বলে আশঙ্কা করছেন জনকল্যাণ সোসাইটির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা।মামলার সুপারিশ ছিল ৪০ জনের বিরুদ্ধে : গ্রাহকের আমানত নিয়ে যুবক-এর সম্পত্তি আত্মসাতের দায়ে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষপদে নিয়োজিত ৪০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করেছিল যুবকবিষয়ক কমিশন। সেই আলোকে ব্যবস্থা নিতে ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। একই সঙ্গে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী যুবক-এর সম্পত্তি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ হস্তান্তরে কোনো ধরনের মানি লন্ডারিং হয়েছে কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে। যুবক-এর কর্মকর্তারা যাতে তাদের কোনো জমি গোপনে বিক্রি করতে না পারেন সে লক্ষ্যে সারা দেশের ১৯টি জেলার জেলা প্রশাসককে ওইসব সম্পদ নজরে রাখার নির্দেশনা দিয়েও চিঠি দিয়েছিল ব্যাংকিং বিভাগ।
এখন কী হবে : যুবক বিষয়ে এখন কী হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, যুবক কমিশনের সুপারিশ মেনে প্রতিষ্ঠানটির অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুেদ্ধ মামলাসহ তাদের দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি লেখা হয়েছিল ২০১৩ সালে। এরপর ওই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেটি জানতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে আবারও চিঠি দেওয়া হবে।
যুবক বিষয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে সারা দেশে যুবক-এর যে সম্পদ রয়েছে তার মূল্য হয়তো ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা হবে, যা ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের দাবিকৃত অর্থের তুলনায় খুবই সামান্য। এখন এই সম্পদ সরকারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে সব গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করা একেবারেই অসম্ভব। তবে বৈঠকে যেটি আলোচনা হয়েছে, সেটি হলো, অর্থমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী যে পরামর্শ দেবেন সেভাবেই যুবক বিষয়ে সরকারের অবস্থান চূড়ান্ত হবে।