শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নৌ দুর্ঘটনা রোধে দরকার জিরো টলারেন্স নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নৌ দুর্ঘটনা রোধে দরকার জিরো টলারেন্স নীতি

ড. এম রফিকুল ইসলাম

‘আমাদের যাত্রীবাহী নৌযানগুলো নির্মাণের সময় সঠিক নিয়ম যদি মানা  হতো, তাহলে এত ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটত না। নৌ দুর্ঘটনা রোধে আমাদের নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), নৌপুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট— সবাইকে সব সময় তত্পর থাকতে হবে। সরকার জঙ্গি তত্পরতা রোধে যেভাবে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে একইভাবে লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধেও জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা দরকার।’ এ ছাড়া দুর্ঘটনা রোধে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় লোকবল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. এম রফিকুল ইসলাম। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, যদি একটি যাত্রীবাহী নৌযানের নকশা একজন নৌ প্রকৌশলীকে দিয়ে করানো হয় তবে এটি কখনো ডুবতে পারে না। কারণ এ যানগুলোর নকশা যখন করা হয় তখন প্রথমেই মাথায় রাখতে হয় যে, কোনো কারণে যদি এটি দুর্ঘটনায় পড়ে তবে যানটিকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে তা পানিতে ডুবে না যায় বরং পানিতে ভাসতে থাকে। অনেকটা বেলুনের মতো। অর্থাৎ যতক্ষণ বেলুনটি ফুটো হয়ে না যাবে ততক্ষণ এটি নিয়ে একজন ভাসতে পারবে। ঠিক একইভাবে জাহাজের ভিতর পানি নিরোধক চেম্বার থাকে। এর ফলে কোনো কারণে যদি একটি নৌযান দুর্ঘটনায় পড়ে তাহলে এটি ডুবে ডুবে হলেও ভেসে থাকবে। যদি একজন নৌ প্রকৌশলী একটি নৌযানের নকশা করেন তাহলে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই করবেন। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বরিশালে যে নৌযানটি দুর্ঘটনায় পড়েছে তাকে লঞ্চ বলা ঠিক হবে না। কারণ এর দৈর্ঘ্য ২৪ মিটারের এবং নিচে তা ১৬-১৭ মিটারের বেশি হবে না। আর এ নৌযানটির নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশনও নেই। এটি আসলে এক ধরনের নৌকা। আমি অবাক হই এই ভেবে যে, এ ধরনের যান নদীতে কীভাবে চলতে দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে দেশে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশনকৃত নৌযানের সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। কিন্তু এ যানগুলোর সার্ভেয়ার বা জরিপকারী মাত্র কয়েকজন। একজন নৌ প্রকৌশলী তার দক্ষতা কাজে লাগিয়েই এ যানগুলোর নকশা ও জরিপ করেন। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এমন দক্ষ লোকবলের অভাব আছে। এর ফলে সঠিকভাবে এগুলোর সুপারভিশন করে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেবে সে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা মন্ত্রণালয়ের নেই। আমি শুনেছি যে, এই মন্ত্রণালয় তাদের লোকবল বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বিষয়ে আমার পরামর্শ হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় লোক না নিয়ে যে ধরনের লোকবলের আসলেই প্রয়োজন তাদের যেন অবশ্যই নিয়োগ দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে লঞ্চ দুর্ঘটনা একেবারে বন্ধ করা না গেলেও প্রাণহানি কমানো যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর সবাই তত্পর হয়ে ওঠেন। কিছুদিন পর সেই তত্পরতা কমে যায়। পৃথিবীতে কোনো দেশের রেগুলেটরি বডি এই নৌযানসংশ্লিষ্ট বিষয় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পৃথিবীজুড়ে নৌযানগুলোর নকশার অনুমোদনসংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব লোকাল ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি বা ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির হাতে দেওয়া হয়। সাধারণত বিভিন্ন দেশে যখন কোনো নৌযানের নকশা করা হয় তখন এই ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির অনুমোদন নেওয়া হয়। আবার যখন যানগুলো নির্মাণ করা হয় তখনো এ প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজের তদারকি করে। আবার প্রতি বছর এ যানগুলোর সার্ভে কাজের তদারকিও তারা করে। অথচ আমাদের দেশে ঘরে বসে নামমাত্র সার্ভে করা হয়।’ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বরিশালে যে যানটি দুর্ঘটনায় পড়েছে এ রকম প্রায় ২০ হাজার যান আছে যেগুলো রেজিস্টার করা হয়নি। এগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের লোকবল বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। ২০০৩ সালে আমি নিজে পরিদর্শনে গিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর ত্রুটিপূর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ নৌযান দেখতে পাই। বিশেষ করে মংলা, সিলেট, বরিশাল, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে ছোট ছোট প্রচুর নৌযান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আর এ যানগুলো কোনো নৌ প্রকৌশলীর নকশা ছাড়াই আজ থেকে ৩০ বছর আগের তৈরি। এগুলোর মালিকরা কোনোমতে একটা নকশা করিয়ে বিআইডব্লিউটিএ থেকে ছাড়পদত্র নিয়েছেন। আর এ ধরনের যান কখনো নিরাপদ হতে পারে না। তবে এখন বড় যে নৌযানগুলো তৈরি হচ্ছে যার দৈর্ঘ্য ৬০ থেকে ৮০ মিটার এগুলোর নকশা নৌ প্রকৌশলীরা করছেন। এগুলো দুর্ঘটনায়ও পড়ছে না। আর যে যানগুলো মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে দুর্ঘটনায় পড়ছে সেগুলো অদক্ষ মাস্টারের কারণেই দুর্ঘটনায় পড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চগুলো ৩০ বছর আগে তৈরি হয়েছে। আর সঠিকভাবে নৌযান নির্মাণের জন্য বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের তৈরি নকশা মানতে হবে। এমনকি এটি নির্মাণের পরও প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ের পরপর তার সার্ভে করতে হবে। কারণ এগুলো বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর নৌযানের নকশা অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে আলাদা একটি বিভাগ থাকতে হবে। আমি মনে করি নৌ প্রকৌশলী, মাস্টার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার— এই তিন ধরনের দক্ষ লোকের সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। তা না হলে নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’

সর্বশেষ খবর