মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিদেশে কিডনি পাচার

জুলকার নাইন

বিদেশে কিডনি পাচার

বাংলাদেশ থেকে কিডনি দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে রক্ত ও টিস্যু পরীক্ষার পর নেওয়া হচ্ছে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে। সেখানেই কিডনির গ্রাহকরা আসছেন। হচ্ছে কিডনি স্থানান্তর। কিছু সংখ্যক স্থানান্তর হচ্ছে ভারতের চেন্নাইতে। তবে কলম্বোতে বিদেশিদের কিডনি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় সেখানেই হচ্ছে বেশি। কিন্তু দালালরা এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে ভারতের বিভিন্ন শহর থেকেই। তারাই বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় থাকা কয়েক ডজন এজেন্টের মাধ্যমে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাংলাদেশ থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে এসব কিডনি সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগে বিভিন্ন সময়ে কিডনি বিক্রি করা ব্যক্তিরা এখন নতুন বিক্রেতাদের প্রভাবিত করতে এজেন্টের ভূমিকায় নেমেছেন। মূলত ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে কিডনি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া কিডনি কেনাবেচা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক দৈনিক ‘পালস’-এ চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক ‘বাংলাদেশের কিডনি কালোবাজার’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও এ ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কিডনি বাণিজ্যের মূল জোগানদাতা হয়ে কাজ করছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে কিডনি। কিছু সংখ্যক ইরান থেকেও আসছে। তবে মূল জোগান আসছে নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশের ব্ল্যাক মার্কেটের কিডনির চাহিদার বেশিরভাগ অংশ পূরণ করছে বাংলাদেশ ও নেপাল। ভারতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা ও পাকিস্তানিদের বিদেশযাত্রায় সন্দেহের কারণে এই দুই দেশ থেকে সংগ্রহ করা কমে এসেছে। বাংলাদেশেও কিডনি স্থানান্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া বিশাল সংখ্যক লোকের ভিড়ে খুব সহজে ভারতে নিয়ে প্রয়োজনীয় টেস্ট করানো যাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কিডনি বিক্রিতে প্রলুব্ধ করে মূল সংগ্রহের কাজ করছে দালালরা। তবে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের বাধ্য করা হচ্ছে কিডনি দিতে। বেশিরভাগই টাকার জন্য বিক্রি করছে। সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন জেলা থেকে এর আগে কিডনি বিক্রি করা ব্যক্তিরা সহজেই অন্যদের কিডনি বিক্রিতে প্ররোচিত করতে পারছেন। নিজেদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে তারা এসব ব্যক্তি অর্থের লোভে দালালদের সহযোগিতা করছেন।

মার্কিন চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ‘পালস’-এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ১ লাখ ২৩ হাজারেরও বেশি রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের জন্য ডোনার আছেন মাত্র ৫ হাজার। কথিত এ ডোনারদের একটি অংশ বাংলাদেশের, যাদের অর্থের বিনিময়ে  ডোনার বানানো হয়েছে। কিডনির বেচাকেনা নিয়ে তৈরি করা এই ডকুমেন্টারি প্রচার করবে মার্কিন টিভি চ্যানেল ভাইস নিউ। ডকুমেন্টারির ১ মিনিট ৫ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ আগাম বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে টিভি চ্যানেল ও অনলাইনে। এই ডকুমেন্টারিতে বাংলাদেশের এক যুবক বলছেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই কিডনি বিক্রি করে দিয়েছি। আমার স্ত্রী কিডনি বিক্রির পর মারা গেছে।’ ওই যুবকের মা বলেছেন, ‘পরিবারেরর সবার কিডনি বিক্রির পর আর কোনো উপায় না থাকায় আমারও একটি কিডনি বিক্রি করেছি।’ বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারণা করা যায় এই বিক্রেতা পরিবার জয়পুরহাটের কালাইয়ের। কারণ কালাইয়ে এর আগে বিশাল থাবা বসেছিল কিডনি বাণিজ্যের। চিকিৎসা সাময়িকী ‘পালস’-এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কালোবাজারে একটি কিডনি বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পান ডোনার। যারা কিডনি বিক্রি করেছেন, তারা একটি কিডনি নিয়ে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। তাদের একজন জানান, মেয়ের বিয়ের জন্য কিডনি বিক্রি করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।

আইনে যা আছে : ১৯৯৯ সালের ১৩ এপ্রিল মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন করা হয়। এতে বলা হয়েছে— সুস্থ ও সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তি তার দেহের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা বিযুক্তির কারণে তার স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা নেই তা কোনো নিকট আত্মীয়ের দেহে সংযোজনের জন্য দান করতে পারবেন। ‘নিকট আত্মীয়’ বলতে পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রী বোঝানো হয়েছে। এর বাইরে কেউ কাউকে কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গ দান করতে পারবেন না। আইনে ‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’ অর্থ মানবদেহের কিডনি, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, অগ্নাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চর্ম ও টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গ বোঝানো হয়েছে। ১৮ বছরের কম ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের কোনো ব্যক্তি অঙ্গ দান করতে পারবেন না। তবে রিজেনারেটিভ টিস্যুর ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা ভাই-বোন সম্পর্কের হলে এ শর্ত কার্যকর হবে না। আর গ্রহীতাকে দুই বছর হতে সত্তর বছর বয়সের মধ্যে হতে হবে। এদের মধ্যে ১৫ বছর হতে ৫০ বছরের ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পাবেন। আইনে বলা হয়েছে—মানব দেহের যে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা এর বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা লাভ এবং  সেই উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোরূপ প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অথবা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিনি অনূর্ধ্ব সাত বছর এবং অন্যূন তিন বছর মেয়াদি সশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অন্যূন তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর কোনো চিকিৎসক এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিনিও এ বর্ণিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এ ছাড়াও চিকিৎসক হিসেবে তার রেজিস্ট্রেশন বাতিলযোগ্য হবে। এ ছাড়াও এ আইনে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপসহ সব প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে একটি রেজিস্টার সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর