শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সার্কের অস্তিত্বই হুমকিতে

ভারত-পাকিস্তান তিক্ততা, চার দেশ যাচ্ছে না, ইসলামাবাদে সম্মেলন স্থগিত

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

সার্কের অস্তিত্বই হুমকিতে

এত দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এখন অস্তিত্ব সংকটে। প্রতিষ্ঠার ৩১ বছরে এসে ১৯তম শীর্ষ সম্মেলনের এক মাস আগে এই অবস্থা। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় শীর্ষ সম্মেলন এখন স্থগিত। কারণ ভারত, ভুটান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ একযোগে ওই সম্মেলনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অবশ্য সম্মেলন স্থগিত হওয়া ও অস্তিত্ব সংকটের মতো পরিস্থিতি সার্কের ইতিহাসে নতুন নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। পাকিস্তানকে ছাড়াই সড়ক, রেল, জ্বালানি ও অন্যান্য সহযোগিতার একটি প্রক্রিয়া চলছে। আর ভিন্ন ভিন্ন কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে একাধিক দেশের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিও আছে নিজ নিজ রাজনৈতিক মাঠে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র তার টুইটার বার্তায় জানিয়েছেন, ‘যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি তবু বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। পাকিস্তান আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তি রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। এ অঞ্চলের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাব।’

জানা যায়, আগামী ৯ ও ১০ নভেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু গতকাল বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান ও ভুটান ওই সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এর ফলে আট সদস্যের এই জোটের শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। বাংলাদেশ বলেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করায় সে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন পরিবেশে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হলে বাংলাদেশ এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করবে। ভারত জানিয়েছে, আন্তসীমান্ত অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সহায়ক নয়। ভুটান জানিয়েছে, আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাওয়ার ফলে সার্ক সম্মেলন সফলভাবে করার মতো পরিবেশ রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে শঙ্কা থাকার কারণে এবারের সম্মেলন বর্জন করা হচ্ছে। আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশটিতে আরোপিত সন্ত্রাসবাদের কারণে সহিংসতা ও লড়াইয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ও কমান্ডার ইন চিফকে সে পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই আফগানিস্তান সম্মেলনে যোগ দিতে পারছে না। সার্কভুক্ত রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান ও আফগানিস্তান। গণচীন ও জাপানকে সার্কের পর্যবেক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার নেতারা ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা করার লক্ষ্যে সার্ক গঠন করেন। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কের সদস্যপদ লাভ করে। নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্কের সদর দফতর।

টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের সেনা ঘাঁটিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বরের হামলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘একটি দেশ’ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যা সার্ক সম্মেলন সফল হওয়ার জন্য সহায়ক নয়। ওই খবরে বিষয়টিকে ‘পাকিস্তানের প্রতি ভারতের ধমক’ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বিকাশ স্বরূপ মঙ্গলবার তার টুইটারে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ভারত সার্কের বর্তমান প্রধান নেপালের কাছে জানিয়েছে আন্তসীমান্ত অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি সদস্য দেশের লাগাতার হস্তক্ষেপের ফলে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা ১৯তম সার্ক সম্মেলন করতে ইসলামাবাদের জন্য সহায়ক নয়।’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল তার দফতরে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে অব্যাহতভাবে পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করায় ইসলামাবাদে প্রস্তাবিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ‘আমরা গতকাল সার্কের সভাপতি দেশ নেপাল ও সার্ক সচিবালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি যে নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দিচ্ছে না। কারণ হিসেবে আমরা বলেছি, আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক থাকা উচিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি রাষ্ট্রের অব্যাহতভাবে হস্তক্ষেপ এই সম্মেলন আয়োজনের জন্য উপযোগী নয়। পাশাপাশি আমরা বলেছি, সার্কের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা, কানেকটিভিটি ও সার্বিক সহযোগিতার বিষয়টি বিশ্বাস করে। সময় ও সুযোগ যখন আসবে বাংলাদেশ তখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে।’ বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অন্য কোনো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই’ বলেও মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানে হচ্ছে বলেই বাংলাদেশ যাচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সার্কে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করাটা নতুন কিছু নয়। পরিবেশ হলে বাংলাদেশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে, স্থান গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা যেটা বলেছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অব্যাহতভাবে পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করেছে।’ ভারতের উরিতে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে একঘরে করার যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র আছে কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সেটা বলব না। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব একটি সিদ্ধান্ত। আমরা সব সময় বলে আসছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার ও তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো কারও সঙ্গে আপস করেনি এবং করবেও না।’ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে কিনা— এর জবাবে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘সেটা সময়ই বলে দেবে।’ ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীও নয়া দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘উপমহাদেশের শান্তি, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছিল। উপমহাদেশে যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সার্কের মতো শীর্ষ সম্মেলনের পরিস্থিতি নেই। এই অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিস্থিতিতে কোনো আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সফল হবে না। এ ধরনের অনুষ্ঠান অর্থহীন হয়ে যাবে বলেই মনে করে বাংলাদেশ।’ হাইকমিশনার বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশকিছু ঘটনায় আস্থার জায়গায় নেই। পাকিস্তান যেভাবে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, তাতে আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ একাধিকবার নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছে, পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করেছে। তবে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তান মনোভাব বদলায়নি। বাংলাদেশ অসন্তুষ্ট হয়েছে। সার্কের স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনেও বাংলাদেশ অংশ নেয়নি। এই নীরব প্রতিবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। তবে প্রতিবেশীদের ব্যাপারে পাকিস্তানের মনোভাব বদলায়নি।’

ভেন্যু পরিবর্তনের চিন্তা : সদস্যগুলোর সম্মেলনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তিটা পাকিস্তানকে ঘিরে হওয়ায় সম্মেলনের ভেন্যু পরিবর্তনের কথা ভাবছে নেপাল সরকার। নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ড এরই মধ্যে কাঠমান্ডুতে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সার্ক সম্মেলন নিশ্চিত করতে অন্য দেশগুলোর শরণাপন্ন হওয়ার চেষ্টা করা হবে। সর্বসম্মতির নীতি প্রাধান্য দিয়ে সার্ক কাজ করে থাকে। একটি দেশ সম্মেলন বর্জন করলে তা বাতিল হয়ে যায়। অতীতেও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর