বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
শহীদ মিনারে মানুষের ঢল

হাজার চরণ চিহ্ন ফেলে চিরনিদ্রায় সৈয়দ হক

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

হাজার চরণ চিহ্ন ফেলে চিরনিদ্রায় সৈয়দ হক

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে গতকাল সৈয়দ শামসুল হককে শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিদায় সব্যসাচী। সুহৃদ-স্বজন, ভক্ত-অনুরাগী, অগণিত প্রিয়জনকে চোখের জলে ভাসিয়ে প্রিয় শহর ঢাকা থেকে বিদায় নিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তারপর প্রিয় জলেশ্বরীর পাড়ে জন্মস্থান কুড়িগ্রামের মাটিতে চিরজনমের জন্য ঠাঁই নিলেন ‘হাজার চরণ চিহ্ন ফেলে’। গতকাল বিকালে সর্বশেষ জানাজার পর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের মূল গেটের দক্ষিণে ধান খেতের পাশে কবিকে সমাহিত করা হয়। সৈয়দ হককে শেষ বিদায় জানানোর আগে রাজধানী ঢাকা ও জন্মস্থান কুড়িগ্রামে শোকাহত হৃদয়ের বেদনাগুলো অশ্রু হয়ে ঝরছিল অগণিত ভক্ত ও সুহৃদের দুই চোখে। হাতে ফুল ও চোখে অশ্রু দুই মিলিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সৃষ্টি হয়েছিল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত এক আবেগপূর্ণ পরিবেশ। তারা ফুলে ফুলে ঢেকে দেন কবির কফিন। যেন রাজসিক প্রস্থান ঘটেছে দেশবরেণ্য সব্যসাচী লেখকের। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের জনসাধারণ ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করে বিদায় জানায় সাহিত্যের অসামান্য প্রতিভাধর লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। গত মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে সৈয়দ হকের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয়। সাড়ে ১১টার দিকে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে কবির কফিনে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সৈয়দ হকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ ছাড়া শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা। আসেন কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বরেণ্য ব্যক্তিরা। আসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। প্রিয় কবিকে শেষবারের মতো সশ্রদ্ধ বিদায় দিতে লোকে-লোকারণ্য ছিল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। এর আগে সকাল সোয়া ১০টার দিকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘর থেকে তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে নেওয়া হয় কবির মরদেহ। সেখানে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণ থেকে সৈয়দ হকের মরদেহ নেওয়া হয় বাংলা একাডেমিতে। সেখানে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখান থেকে কবির মরদেহ দ্বিতীয় জানাজার জন্য নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদে। এরপর কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী জন্মস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করার জন্য তার মরদেহ হেলিকপ্টরযোগে কুড়িগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সেখানে মরহুম কবির প্রতি রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নুল আবেদীন ও একান্ত সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ডা. দীপু মনি, ড. আবদুর রাজ্জাক, প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, ইমেরিটাস প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. মুহাম্মদ সামাদ, আলী যাকের, সারা যাকের, তারিক আনাম খান, শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ।

প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিকভাবে সৈয়দ হকের মরদেহে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, ঐক্য ন্যাপ, জাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বার কাউন্সিল, নজরুল ইনস্টিটিউট, চারুশিল্পী সংসদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ঢাকা পদাতিক, নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, ছায়ানট, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) প্রভৃতি। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। অন্যান্যের মধ্যে কবিপুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক বক্তব্য দেন। আগামী ১ অক্টোবর শনিবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নাগরিক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে বলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জানাজা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনে উপস্থিত ছিলেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ, নায়করাজ রাজ্জাক, চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন, কবি আসাদ চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলম, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রমুখ। বাংলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেন, জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজার পর জন্মস্থানের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত করার জন্য বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে কবির মরদেহ কুড়িগ্রামে নেওয়া হয় বিকাল ৪টার দিকে। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে স্থাপিত বিশেষ মঞ্চে মরদেহ নেওয়ার পর সেখানে স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর তৃতীয় ও শেষ জানাজার পর বিকাল পৌনে ৫টার দিকে কলেজের মূল গেটের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এ সময় প্রয়াত সৈয়দ হকের ছোট ভাই অ্যাডভোকেট সৈয়দ আজিজুল হকসহ কবি পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন, জেলা পরিষদ প্রশাসক জাফর আলী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম মঞ্জু মণ্ডল, জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর