শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভুয়া পুলিশেই সর্বনাশ

আসলের খবর নেই নকলের ছড়াছড়ি, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি-বাণিজ্য

মাহবুব মমতাজী

ভুয়া পুলিশেই সর্বনাশ

সম্প্রতি বগুড়ায় আটক তিন ভুয়া পুলিশ —ফাইল ছবি

ভুয়া পুলিশ চক্রের অভিনব প্রতারণায় সর্বনাশ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু ব্যবসায়ীরাই নন, এই চক্রের দৌরাত্ম্যে সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসছেন সাধারণ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও এ বিষয়ে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতারকদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পারলেও এখনো তাদের আটক করা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছে, আসলের কোনো খবর নেই, নকলের ছড়াছড়িতে অতিষ্ঠ মানুষ। ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি বাণিজ্য করছে তারা। তাদের দৌরাত্ম্যে অসহায় ব্যবসায়ীরা।

ভুয়া এই পুলিশ চক্রটির টার্গেটে এখন বিকাশ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের পিন কোড জানতে ক্রেতা সেজে দীর্ঘ সময়ে অনুসরণ করে। এরপর কৌশল খাটিয়ে হাতিয়ে নেয় বিকাশ লেনদেনের মোবাইল ফোন সেটটি। হাতিয়ে নেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব টাকা তাদের ব্যক্তিগত বিকাশ অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফারের মাধ্যমে ক্যাশ আউট করে ফেলেন। র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছেন, এই চক্রটির বাড়ি মাদারীপুর এলাকায়। তারা সময়ে সময়ে তাদের কৌশল পাল্টিয়ে এসব কার্যক্রম চালাচ্ছে। চক্রটিকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা গেছে। তবে এখনো পর্যন্ত তাদের আটক করা হয়নি। একই সূত্রে গাঁথা এমন তিনটি ঘটনার তথ্য বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে।

ঘটনা-১, গোলাম সরওয়ার। তিনি বিকাশ এজেন্টের ব্যবসা করেন শনির আখড়ার দক্ষিণ দনিয়াতে। ১৩ এপ্রিল তার বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচ মিনিটের মাথায় এক লাখ ৩৭ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে প্রতারকরা। এর দুই দিন আগ থেকে তারা যাওয়া-আসা করে তার দোকানে। প্রায় ২০-৩০ হাজার টাকাও লেনদেন করেছে তার এজেন্টের মাধ্যমে। এ সময় প্রতারকরা নিজেদের হাইওয়ে পুলিশ পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে ভাব জমান। গোলাম সরওয়ার বলেন, কয়েকদিন ধরে তারা আমার দোকানে লেনদেন করতে আসেন। যেদিন টাকাটা খোয়া যায় সেদিন তাদের একজন আমার এজেন্ট নম্বরে টাকা আসবে বলে পাশে বসে থাকেন। একপর্যায়ে তার পরিচিত একজন এজেন্ট নম্বরে কল দিয়েছে বলে আমাকে জানায়। এ সময় সে এজেন্ট নম্বরধারী মোবাইল ফোনটি নিয়ে কথা বলে মাঝখানে আমাকে কথা বলতে বলে সবার অগোচরে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়। পরে আমি দেখি আমার মোবাইলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি মোবাইল সে রেখে গেছে। অর্থাৎ আমার মোবাইলটা প্রতারক চক্রের ওই সদস্য পরিবর্তন করে নিয়ে পালিয়েছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিকাশ কাস্টমার কেয়ারে সিম ব্লক করতে প্রায় ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে। ততক্ষণে তারা সব টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ক্যাশ আউট করে ফেলেছে। কাস্টমার কেয়ারের তথ্য বিবরণী যাচাই করে দেখি মোবাইল হাতিয়ে নেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছয়টি নম্বরে টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘটনা-২, একই মাসের ২৬ তারিখে প্রতারক চক্রের একই ফাঁদে পড়ে এক লাখ ১৯ হাজার টাকা খুঁইয়েছেন লিটন হাওলাদার নামের আরেক বিকাশ এজেন্ট। তিনি ব্যবসা করেন কদমতলী এলাকার কুদরত আলী বাজারে। ঘটনার পরই তিনি কদমতলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। লিটন হাওলাদার জানান, ঘটনার আগের দিন এক ব্যক্তি হাইওয়ে পুলিশের পরিচয় দিয়ে তার দোকানে ৩০ হাজার টাকা ক্যাশ আউট করেন। পরদিন আবারও এক হাজার টাকা এক ব্যক্তি পাঠাবেন বলে তিনি পাশে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর এজেন্ট নম্বরে তার এক পরিচিত ব্যক্তি কল দেয়। এ সময় সে কলের বিষয়টি জানিয়ে কথা বলতে চাইলে তার হাতে মোবাইল ফোনটি দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তার সঙ্গে অপর প্রান্তের ব্যক্তি কথা বলবেন বলে ফোনটি তার হাতে ধরিয়ে দেন। বেশ কিছুক্ষণ অপরপ্রান্তের কল দাতা কথা পেঁচাতে থাকেন। এর মধ্যে প্রতারক ব্যক্তিটি পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে হাতে মোবাইল ফোনটি নিয়ে দেখি হুবহু সে আরেকটি মোবাইল দিয়ে পরিবর্তন করে বিকাশ এজেন্ট সিমটি নিয়ে গেছে। বিকাশ কাস্টমার কেয়ারে সিম ব্লক করতে গিয়ে দেখি তারা চারটি নম্বরে অ্যাকাউন্টের সব টাকা ট্রান্সফার করে ফেলেছে। ঘটনা-৩, গত ১৩ আগস্ট একই ধরনের প্রতারকদের আরেক ফাঁদে পড়েছেন মো. শরীফ হোসেন নামের এক বিকাশ এজেন্ট। এদিন তার এক লাখ ৪৮ হাজার টাকা খোয়া যায়। মিরহাজীরবাগ কাঁচাবাজার এলাকায় দোকান রয়েছে তার। তিনি জানান, এক লোক পুলিশের এসআই পরিচয় দিয়ে তার দোকানে নিয়মিত যাতায়াত করত। মাঝে মধ্যে বিকাশে টাকা লেনদেন করত। ঘটনার দিন তার এক বন্ধু টাকা পাঠাবে বলে সে দোকানের সামনে থাকা টুলে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরক্ষণে তার বন্ধু এজেন্ট নম্বরে কল দিয়ে জানায় সে কথা বলতে চায়। তাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলে সে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দেয়। সে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর এজেন্ট সিমের মোবাইল ফোনটি যাচাই করে দেখলে জানা যায় সেটি পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই মোবাইলে সিমটি ব্লক করতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। এরপর কাস্টমার কেয়ারের তথ্য-বিবরণীতে দেখা গেছে যারা মোবাইল নিয়েছে তারা পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাতটি ব্যক্তিগত বিকাশ অ্যাকাউন্টে সব টাকা ট্রান্সফার করে ফেলে। ঘটনার পরই তিনি সুষ্ঠু সমাধান পেতে যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। ওইদিনের পর থেকে পুলিশ পরিচয়ধারী ব্যক্তিটিকে তিনি তার দোকানে আর দেখেননি। ভুক্তভোগী তিনজনই ঘটনাগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে র‌্যাব-১০ এ অভিযোগ দিয়েছেন। র‌্যাব-১০-এর অধিনায়ক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, প্রতারক চক্রগুলোকে ধরতে আমরা তদন্ত করছি। কিছু কিছু প্রতারককে ধরাও হচ্ছে। এ বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা এবং দ্রুত আটকের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর