শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
দেখার কেউ নাই

অরক্ষিত কূটনৈতিক পল্লী

মাদানী সড়কও দখলবাজদের কবলে

সাঈদুর রহমান রিমন

অরক্ষিত কূটনৈতিক পল্লী

দখলবাজদের কবলে ১০০ ফুট মাদানী এভিনিউ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

‘মাদানী এভিনিউ’ খ্যাত একশ ফুট সড়কটিও মুক্ত রাখা যাচ্ছে না, দখলবাজরা তা গিলে খাচ্ছে। কূটনৈতিক পল্লীর এ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, ফুটপাথ, মাঝের আইল্যান্ড-কোনোকিছুই ফাঁকা থাকছে না, যে যার মতো দখল করে নিচ্ছে। কারও বাড়িঘরের বারান্দা বাড়িয়ে, রাস্তা-ফুটপাথজুড়ে দোকানপাট বসিয়ে, কেউবা হকার্স মার্কেট সাজিয়ে কায়েম করছে দখলস্বত্ব। ফুট বাই ফুট হিসেবে পজেশন বাবদ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বসানো হয়েছে সহস্রাধিক দোকানপাট। এসব দোকান থেকে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই রাস্তা-বাজার থেকেই প্রতি মাসে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৩০ লক্ষাধিক টাকা।

একশ ফুট প্রশস্ত রাস্তাটি বেরাইদসহ পূর্বাচল ও রূপগঞ্জে সহজ যোগাযোগের জন্যই নির্মিত হয়। সড়কটি রাজধানীর বাইপাস রোড হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা ছিল। কিন্তু এর নির্মাণকাজ কয়েক বছর ধরে ফেলে রাখায় তা দখলবাজদের খপ্পরে হারিয়ে যেতে বসেছে। হাজার হাজার মানুষের ব্যস্ততম রাস্তাটি এখন আর খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। নতুনবাজারের ভাটারা থানা মোড় থেকে একশ ফুট রাস্তার এক কিলোমিটার জুড়ে দীর্ঘ বাজার বসানো হয়েছে। সেখানে ৮-১০টি হকার্স মার্কেট গড়ে তোলার পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। থানার ঠিক বিপরীত পাশেই ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের গেট জুড়ে রিকশা-অটোর স্থায়ী টার্মিনাল গজিয়ে উঠেছে। অগ্নিকাণ্ডের জরুরি খবর পেলেও গেটমুখের রিকশা, অটো, সিএনজির জটলা পেরিয়ে দমকল বাহিনীর গাড়ি বেরোতেই ১৫ মিনিট লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিসের দফতর পেরিয়েই অবস্থিত সৌদি দূতাবাসের চারপাশ ঘিরে দখলবাজির বেহালদশা দেখার যেন কেউ নেই। স্থায়ী-অস্থায়ী শত শত দোকানের পসরায় মাদানী এভিনিউর প্রবেশমুখই ‘ভিড়-ভাড়াক্কার হাট-বাজারে’ পরিণত হয়েছে। এসব বাজার, দোকান, স্ট্যান্ডের জটলা এড়িয়ে এঁকেবেঁকে যানবাহন চলাচল করতে গিয়েই বেঁধে যাচ্ছে যানজট। সেখানে বিভিন্ন সংগঠনের নামে রাস্তার জায়গা রীতিমতো পজেশন আকারে কেনাবেচা পর্যন্ত চলছে। শুধু সড়কের জায়গা দখল করতেই নামের আগে-পিছে ‘লীগ’ আর ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ব্যবহার করে বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংগঠন খুলে বসেছে কেউ কেউ। অবৈধ দখলবাজদের কাছ থেকে থানা পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগের নামেও লক্ষাধিক টাকা মাসোয়ারা আদায় হয় বলে জানা গেছে। মাদানী এভিনিউর মাঝামাঝি স্থানে ফুটপাথের পুরোটাই গিলে খেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সাইনবোর্ড সর্বস্ব সংগঠন কার্যালয়গুলো। সেখানে ভাটারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, ভাটারা থানা আওয়ামী যুবলীগ ও থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যালয় স্থাপনের নামে আশপাশে আরও দোকানপাট গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। রাস্তার মাঝামাঝি আইল্যান্ড জুড়ে ফলের দোকান, মাছের বাজার, হোটেল রেস্তোরাঁ পর্যন্ত গজিয়ে উঠেছে। রাস্তায় দোকানপাটের পসরা সাজিয়ে বসা খুদে দোকানিরা জানান, প্রতিদিন ‘পুলিশের বিট’ বাবদ ২০ টাকা, ‘হকারদের কল্যাণকারী সংগঠনের চাঁদা’ বাবদ ১০ টাকা এবং স্থানীয় ক্লাব-সমিতির নামে ‘মাস্তানি ভাতা’ বাবদ আরও ৩০ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য একজন করে দোকানদার ‘লাইনম্যান’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া কমিশন পান রাজউক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। মাদানী এভিনিউয়ে সৌদি দূতাবাসের পূর্ব কোনায় রাস্তার ওপরই জিন্স প্যান্টের দোকান দিয়ে বসেছেন একজন খুদে ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, রাস্তার মাঝখানে রোড ডিভাইডারে চার হাত বাই পাঁচ হাত জায়গায় দোকান বসাতে গিয়ে এককালীন দিতে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। এখন প্রতিদিন ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়, পাশাপাশি চাঁদা দিতে হয় ৫০ টাকা। তিনি বলেন, ‘বেচাকেনা ভালো বলেই পুষিয়ে নিতে পারছি।’ পাশেই ফলের বাজারে দোকানপ্রতি ১০০ টাকা করে দৈনিক ভাড়া দিতে হয় তাদের। দখলবাজ চাঁদা আদায়কারীদের কবল থেকে ভ্রাম্যমাণ হকাররা পর্যন্ত রেহাই পান না। ঘুরে ঘুরে ডিম, মুড়িভাজা, পান-সিগারেট বিক্রেতাদের কাছ থেকেও ২০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হচ্ছে।

দখলবাজরা গিলে খাচ্ছে সব : ফুটপাথসহ রাস্তা দখলবাজি কী ভয়ঙ্কর অভিশাপ ডেকে আনে তা প্রগতি সরণিতে যাতায়াতকারী মানুষজন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ব্যস্ততম ওই সড়কের বারিধারা অংশের ফুটপাথ ও রিকশার লেনটি আরও কয়েক বছর আগেই দখলবাজরা নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। তারা সরকারি রাস্তা ও ফুটপাথ পজেশন আকারে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ফলে ১২০ ফুট প্রশস্ত প্রগতি সরণি দিনে দিনে ৮০ ফুটে নেমে এসেছে। অপ্রশস্ত এ রাস্তার মধ্যেও এক লেন দখল করে বানানো হয়েছে অঘোষিত পার্কিং পয়েন্ট। ফলে শত শত যানবাহন নর্দ্দা ওভারব্রিজ থেকে সুবাস্তু টাওয়ার পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার সড়কে খুব সতর্কতার সঙ্গে ধীরগতিতে একটি একটি করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এটুকু রাস্তা পেরোতেই বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কারের এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। ওই তিন কিলোমিটার রাস্তায় ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুঃসহ যানজটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন হাজার হাজার যাত্রী-পথচারী। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের চার নেতা আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তার ফুটপাথ ও রিকশার লেন দখল করে নিয়েছেন। তারা পজেশন আকারে অন্তত ৬০০ দোকান, গাড়ি-ফার্নিচারের শোরুম, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, সিকিউরিটি গ্রুপ, ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। পজেশন বিক্রি থেকেই তারা কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন পজেশনধারী দোকানিদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেওয়ার ভিত্তিতে থানা পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগ শুধু তাদের বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত করে দিচ্ছে। সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি ওয়ার্কশপ ও গাড়ির শোরুম-সংলগ্ন মূল রাস্তায় নির্বিঘ্নে সারি সারি গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ করে দেওয়া। মাসোয়ারা প্রদানকারীরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান-সংলগ্ন ফুটপাথ ও রিকশার লেন ঘিরে সীমানা-বেড়া লাগানোসহ রংবেরঙের বাতিতে সাজিয়ে রাখারও সুবিধা পান।

সর্বশেষ খবর