মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্ক সদস্যদের নিয়ে সম্মেলন

যুদ্ধাবস্থা কাটাতে অবশেষে ফোনালাপ

ঋতুপর্ণা রায়, দিল্লি

শুনতে বিস্ময়কর লাগলেও উরি-পরবর্তী কূটনীতিতে এই মেকানিজমকেই আগামী মাসে বাস্তব করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে মোদি সরকার। ইসলামাবাদের সার্ক ভণ্ডুল হয়ে গেছে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে।

একমাত্র আয়োজক দেশ পাকিস্তান ছাড়া সার্কভুক্ত সাতটি দেশই বয়কট করেছে সম্মেলন। সূত্রের খবর, এই গোটা বয়কট-রাজনীতিতে ভারতের প্রত্যক্ষ কূটনীতি রয়েছে। এবার তার থেকে আরও  এক ধাপ এগিয়ে আগামী মাসে গোয়ায় বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনোমিক কো-অপারেশন) সম্মেলনে পাকিস্তানকে বাইরে রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমন্বয় ও যোগাযোগ বাড়ানোর নকশা তৈরি করবে ভারত। সাত সদস্যবিশিষ্ট (বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড) বিমসটেকের পাঁচটি দেশই সার্কভুক্ত। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানকেও যাতে বিমসটেকের পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে নেওয়া হয় তার জন্য জোরালো আবেদন করবে ভারত গোয়ায়। এখন পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তাতে এ ব্যাপারে সর্বসম্মতির সম্ভাবনাই রয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তান ছাড়া সার্কের সব কটি দেশকেই বিমসটেকের মঞ্চে নিয়ে আসার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ।

বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার মতে, ‘সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে আঞ্চলিক স্তরে পাকিস্তানকে চাপে রাখার একটা কৌশল তো রয়েছেই। অর্থনৈতিকভাবে যদি ইসলামাবাদকে কোণঠাসা করা যায়, তবে তাদের মদদপ্রাপ্ত জঙ্গি সংগঠনগুলোও দুর্বল হবে। পাশাপাশি পাকিস্তানকে আঞ্চলিক উদ্যোগগুলো থেকে বাইরে রাখলে বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে যে বাড়তি গতি আসবে এটাও ঘটনা। আঞ্চলিক বাণিজ্য, শক্তি, সড়ক সংযোগ ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে এগোনো সম্ভব হচ্ছে না, পাকিস্তানের বাগড়ায়।’ নয়া দিল্লির কূটনৈতিক অফিসারদের বক্তব্য, সার্ককে ক্রমে অকেজো করে দিয়ে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে তাদের মেগা বাণিজ্যিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে বেইজিং অর্থনৈতিক করিডর করছে ইসলামাবাদের সঙ্গে, যাতে অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার জি পার্থ সারথির মতে, ‘ভারত এখন পাকিস্তান সম্পর্কে যে মনোভাব নিয়ে চলছে তা হলো, তোমরা চীনের সঙ্গে যা করছ কর, আমরা আমাদের মতো উন্নয়নের দিকটা বুঝে নেব। সেজন্য পাকিস্তান যেদিকে হাঁটছে, আমরা তার বিপরীত পথে হেঁটে বাকি রাষ্ট্রগুলোকে আমাদের সঙ্গী করে নেব।’ মোদির প্রস্তাবিত সার্ক স্যাটেলাইট প্রকল্প, গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি, ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান সড়ক চুক্তি— এ সবকটিই মুখ থুবড়ে পড়েছে পাকিস্তানের অসহযোগিতায়। তাই ভারত পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, ভুটান আর নেপালকে নিয়ে (বিবিআইএন) মোটর ভেহিক্যালস চুক্তি বাস্তবায়ন করতে চলেছে। ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করে পাকিস্তানকে এড়িয়ে পশ্চিম এশিয়ায় পণ্য পাঠানোর ব্যবস্থা করছে।

সূত্রের খবর, ১৬ অক্টোবর গোয়ার বিমসটেকে প্রাথমিকভাবে চারটি বিষয়ের ওপর কৌশল রচনা হবে তা হলো শিল্প ও বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ, শক্তি ক্ষেত্রে বাণিজ্য এবং আবহাওয়া পরিবর্তন। শুধু বিমসটেকই নয়, পাকিস্তানকে বাইরে রেখে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য শুকিয়ে যাওয়া সাব রিজিওনাল (উপ-আঞ্চলিক) মেকানিজমগুলোতেও এবার অক্সিজেন জোগানোর দিকে মন দিচ্ছে মোদি সরকার। যেমন ২০০১-এ তৈরি হয়েছিল সাসেক (সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকনোমিক কো-অপারেশন প্রোগ্রাম)। সদস্যভুক্ত দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। তৈরি হওয়ার পর থেকে কার্যত কুম্ভকর্ণ দশা চলছিল সাসেকের। উরির পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ভারতেরই নেতৃত্বে একটি পিওএ (প্ল্যান অব অ্যাকশন) তৈরি করা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২৫— আগামী ১০ বছরের প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও শক্তি প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করা শুরু হয়েছে।

অবশেষে ফোনালাপ : যুদ্ধাবস্থা অবসানে অবশেষে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ফোনালাপ হয়েছে। চলমান উত্তেজনা নিরসনে দুই দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে এই ফোনালাপ হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলায় ১৮ সেনা নিহতের ঘটনার জের ধরে গত সপ্তাহে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় ভারত। এরপরই দুই দেশ রণ সাজে সজ্জিত হয়। গত পরশু রাতে ফের কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় এক ভারতীয় সেনা নিহত হয়। এ উত্তেজনার মধ্যে গতকাল উভয় দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টারা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাজির জানজুয়া নিয়ন্ত্রণ রেখায় চলমান উত্তেজনা নিরসনে একমত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সারতাজ আজিজ। তিনি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ রেখায় উত্তেজনা নিরসন করে কাশ্মীরে মনোযোগ দিতে চায় পাকিস্তান।’ এদিকে, রবিবার রাতে ভারতের ৪৬ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে হামলার পর ভারতজুড়ে সার্চ অপারেশন শুরু হয়। হামলায় এক বিএসএফ সদস্য নিহত ও অপর একজন আহত হয়েছেন। কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গিরা রবিবার শেষ রাতের দিকে হামলা চালায়। তিন ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি চলে।

ভারতীয় উপকূলের দিকে দুই পাকিস্তানি নৌকা : দুটি সন্দেহজনক পাকিস্তানি নৌকা করাচি বন্দর থেকে ভারতীয় উপকূলের দিকে যাত্রা করেছে দাবি করে ভারতের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে সতর্ক করেছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। নৌকাগুলো গুজরাট কিংবা মহারাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যেতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। রবিবার গুজরাট উপকূলে নয়জন আরোহীসহ একটি পাকিস্তানি  নৌকা আটকের পর গতকাল এ সতর্কতা দেওয়া হয়।

কাশ্মীর সফরে রাজনাথ : ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে টানটান উত্তেজনার মধ্যে কাশ্মীর পরিদর্শনে গেলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। দুই দিনের সফরে গতকাল কাশ্মীরের লেহ এবং কারগিল পরিদর্শন করেন রাজনাথ। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে সেখানকার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি তাদের পরামর্শও নেবেন রাজনাথ সিং। কথা বলবেন সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও। এদিকে লেহ ও কারগিল সফরের চব্বিশ ঘণ্টা আগেই বারামুলায় বিএসএফ এবং রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলা নিয়েও মুখ খুলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর