মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
যাপিত জীবন

আমি কার দাস

শারমিনী আব্বাসী

আমি কার দাস

ইস্কুলে যাবার পথে একটি বিলবোর্ড  চোখে পড়ত ‘অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই’। শিউরে উঠতাম। না না, আমি কখনো শয়তানের ভাই-বোন নই। আর কে বা কারা এও বলেছিল, ঈশ্বর থাকেন উপাসনালয়ে, শয়তান থাকে হাটবাজারে। সেই থেকে এতটা বছর কুকুরের যেমন হয় জলাতঙ্ক, আমার হয়ে গেল পণ্য-আতঙ্ক। দোকানপাট, বাজারঘাট জিনিসপত্রে আমার যমের মতো ভয়। ভাবা যেতে পারে এ তো ভালো  কথা। বিশ্বকে যখন গ্রাস করে কনজুমারিজম নামের ভয়ঙ্কর ব্যাধি, যার সঠিক নাম ‘পণ্যদাস’— সে ক্ষেত্রে এটি তো মেঘ না চাইতেই জল— এক অলীক আশীর্বাদ। কিন্তু বাঁচতে হলে কিছু তো লাগে। নিত্য প্রয়োজন, এর বিয়ে, ওর জন্মদিন, ছেলে-মেয়ের ব্যবহার্য। ওসব দিনে দুরু দুরু বক্ষে অর্জুনের মতো তীর ঢালোয়ার নিয়ে তৈরি হই অথবা যেন দামোদর নদ পাড়ি দিচ্ছি প্রবল বিক্রমে। তেমনি সাহস সঞ্চয় করে পথে নামি! বরাবরি আমি অঙ্কে কাঁচা তবে কবে যে পথটাই হয়ে গেল খাদ টের পেলাম না। উইন্ডো শপিং বলে একটা শব্দ আছে। যখন মার্কিন দেশে পড়াশোনা করি ব্যাপারটার অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই বুঝলাম না। জিনিস দেখে আনন্দের কী আছে। পণ্য মানুষকে কি সুখ দিতে পারে? একটা ভালো গান সকালবেলার টোরিকে বদলে দিতে পারে বিকালবেলার পূরবীতে। একটি বসরাই গোলাপ পারে উড়িয়ে দিতে বিষণ্ন মনের ছাইগুলোকে। পণ্যের মতো ছাইপাশের আছে সেই সাধ্য? শুধু কি পাশ্চাত্য? সৌদি আরবের নিউ মদিনায় যা দেখলাম ভুলব না। শুধু মেয়েদের পায়ের জুতোর জন্য রয়েছে মাইলের পর মাইল দৈর্ঘ্যের মল। একেকটি দোকান দশ তলা এবং তাতে লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় জুতো এসে স্থান করে নিয়েছে আমাদের সবচেয়ে পবিত্র স্থানের পবিত্র মলে। আল্লাহ তায়ালা কখনো কি এই বড়লোকী সহ্য করবেন? আমাদের নবীর মাত্র এক জোড়া স্যান্ডেল ছিল বলে শুনেছি, তাতেও তালি লাগানো। এত বৈভব, এত কনজুমারিজম, এত বৈপরীত্য সোনার মদিনার মাটিতে? যাতে বিশ্বাস করি তা হলো পরিপূর্ণ বিশ্বাস। আদর্শ জীবন, মহৎ জীবন, সরল জীবন, দরিদ্র জীবন। বিশ্বাস জানাব একটিতে আর কার্যক্ষেত্রে তার উল্টো, তা হতে পারে না। দোকানপাট না হয় বন্ধ হলো। ট্রাফিক জ্যামের কল্যাণে। ইদানীং লক্ষ্য করি কারা যেন কলিংবেল টেপে। পরিচারিকারা প্যাকেট নেয়-দেয়। টাকা আদান-প্রদান হয় সুকৌশলে। দু-চার দিন পর বুঝলাম। কন্যা অনলাইন শপিং করছেন। দোকান এখন ফোনের ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরেই এবং দুনিয়ার অপ্রয়োজনীয় জিনিস গজিয়ে দিচ্ছে দুয়ারে দুয়ারে। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে বিশ্ব। সেদিন মার্কিন প্রবাসী এক মহিলা আমার ষোড়শী কন্যাকে ভাইবারে মেসেজ দিলেন— অমুক দোকান থেকে লুই ভিটন নামক ব্যান্ডের একটি নকল ব্যাগ কিনে পাঠাতে পারবে কিনা। ব্র্যান্ড বলে একটি কথা আছে। মানলাম সেই ব্র্যান্ড লয়ালিটি। অর্থাৎ যে অ্যাপেল প্রডাক্ট কিনবে তা সে যত দামই হোক না কেন সে ওই পণ্যটির প্রতি এক ধরনের অনুরাগ বা বিশ্বস্ততায় আবদ্ধ। কিন্তু নকল পণ্য কিনে সেটি খোদ আমেরিকায় পাঠিয়ে ব্যবহূত হবে। মানুষের চেতনার এতটা দীনতা মেনে নেওয়া যায়? আবার নকল ব্যাগটির দামও কম নয়। সাত হাজার টাকা। আসলে খিদে বরাবর মেটে। মেটে না নেশা। কারও পাঁচ হাজার ফেসবুক বন্ধু আছে মানে আসলে তার কেউ নেই— ঠিক তেমনি। দাদি-নানির পাশে ঘুরঘুর করে ছেলেবেলা কাটাতাম। তারা কিছুতেই জিনিস অপচয় করতেন না। এটা দিয়ে ওটা দিয়ে সেটা? এ যুগে যেটা রিসাইক্লিং সে যুগেও তারা সেটা ভালোই জানতেন। একদিন রাগ করে দাদিকে বললাম একি, তুই কি টোকাই। সব জমিয়ে রাখছ কেন? সহাস্যে বললেন, ময়না! একদিন বুঝবি সংসার কি অর্থ দিয়ে চলে? সংসার চলে বুদ্ধি দিয়ে। তাদের শুভ্র বসনা সংসারগুলোতে সব ছিল শুধু অর্থ ছাড়া। হায়রে দাদুমণি! বুদ্ধিখানা নেই তাই সুগৃহিণীও হতে পারলাম না। হাটবাজারও চিনলাম না। না হতে পারলাম ঈশ্বরের দাস। না হতে পারলাম পণ্যদাস। আর এখন তো পায়ে পায়ে পালাবার জায়গা খুঁজে মরি। নেই দিগন্ত। নেই অভিমুখ। এ সমাজে আমাদের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। তবে পাশ্চাত্যে নতুন প্লাবন জাগছে। ‘মিনিমালিস্ট’। বাঁচব পাখির মতো। ভারহীন। অনেকে বলেন শপিং থেরাপি। জিনিস কিনলে নাকি মন ভালো হয়। আমি বিস্মিত হই। আমার আশপাশের কত মানুষ যে অসুস্থ। বাজেট থেকে কিছু সাশ্রয় করলেই কত মানুষের ওষুধটুকুর জোগান জুটে যায়। মাত্র ৩৮০ টাকায় উত্তরবঙ্গে পানিবন্দী একটি পরিবারের দুই দিনের রসদ জোগান সম্ভব। সে খবরটুকু ছেলেকে জানাতে সে দৌড়ে আনল তার মাসের বরাদ্দ থেকে একটি ৫০০ টাকার নোট। ‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে’। সেজন্য জিনিস কিনে যদি আমার মন ভালো হয় তবে আমি নিশ্চিত মানসিকভাবে অসুস্থ। অনেকে আমাকে পাগল বলেন। সেটি আমার হার মানা হার। সানন্দে মেনে নিই মিলটনের সেই কবিতাটি Those who danced were thought insane by those who could not hear the music যারা নৃত্যরতদের পাগল ভেবেছিল তারা সুরের মূর্ছনাই শুনতে পায়নি। লেখক-আইনজীবী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর