বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সরকার সমর্থকদের খনোখুনি

মাহবুব মমতাজী

সরকার সমর্থকদের খনোখুনি

তারা রাজনীতি করেন। সবাই সরকার সমর্থক। কেউ আওয়ামী যুবলীগ, কেউ ছাত্রলীগ বা কেউ আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী সংগঠনের সদস্য। একই আদর্শের অনুসারী হলেও একে অন্যের সঙ্গে তাদের আজন্ম এক শত্রুতা। কারণ একটাই, এলাকায় আধিপত্য, চাঁদাবাজি আর ভাগবাটোয়ারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতার রাজনীতির বলয়ে একশ্রেণির সরকার সমর্থক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী দেশের বিভিন্ন স্থানে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট হওয়ায় ঢাকা, গাজীপুর, ফেনী, বগুড়া, লক্ষ্মীপুর, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তারাও বলছেন, দলীয় কোন্দলে এসব খুনের ঘটনা ঘটছে। সব চাঞ্চল্যকর ঘটনার তদন্ত করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ খুনের ঘটনা ঘটে আধিপত্য আর ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্বে। ক্ষেত্রবিশেষ পদ-পদবি বা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব ঘটানো হয়। তবে পরিবারের সদস্যরা বলছেন, রাজনৈতিক কারণে শত্রুর সৃষ্টি হয়েছে। একই দল হলেও প্রতিপক্ষ শক্তিশালী থাকলে এসব ঘটনার বিচার হচ্ছে না। জানা যায়, মতিঝিলের এজিবি কলোনি এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের বিরোধের জেরে যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বাবুর বাবা আবুল কালাম মতিঝিল থানায় ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। অভিযুক্ত আসামিরা হলেন হিরক, মিলন, রাজা, আমিনুল, সানি ও আলম। তারা সবাই যুবলীগের নেতা-কর্মী। এদের মধ্যে পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ফুটপাথের এক দোকানদার বলেন, কলোনির আশপাশে বাবু আর অভিযুক্তদের আনাগোনা ছিল। এ এলাকায় চাঁদাবাজি তারাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। চাঁদার টাকার ভাগবাটোয়ারার কারণেই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। যে কারণে বাবুর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়দের এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এসব ঘটনায় চাঁদাবাজি, আধিপত্য অনেক কিছুই থাকে। তদন্ত চলছে। সত্য উদ্ঘাটন হবেই।’

২০১৩ সালের ২৯ জুলাই যুবলীগের নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে রাজধানীতে একটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার ভাই রাশেদুল হক খান বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযুক্ত আসামিরা হলেন সাখাওয়াত হোসেন, ফাহিমা ইসলাম, জাহাঙ্গীর মণ্ডল, শহীদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, সোহেল মাহমুদ, চুন্নু মিয়া, মোহাম্মদ আরিফ, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, শরিফউদ্দিন চৌধুরী। তারাও সরকার সমর্থক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মতিঝিলে বাবু হত্যার সঙ্গে মিল্কী হত্যার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোয় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ তদন্ত করে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দা পুলিশও তদন্ত করে। এসব ঘটনার কিছু কারণ এজাহারে উল্লেখ থাকে। সে অনুযায়ী তদন্ত চলে। তদন্ত শেষে আসল ঘটনা বলা সম্ভব হয়। ৬ সেপ্টেম্বর ফেনী সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের মধুয়াই ব্রিজ এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে জয়নাল আবেদীন নামে এক যুবলীগ নেতা নিহত হন। জয়নাল ওই ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য। অভিযোগ আছে, পারিবারিক একটি অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে তার ওপর হামলা করেন আওয়ামী লীগ নেতা কামাল মেম্বার ও তার লোকজন। এ সময় জয়নালকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

গত বছরের ২১ আগস্ট গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রায় জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভা চলাকালে উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন, কালিয়াকৈর পৌর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। এ সময় প্রতিপক্ষের ১০-১২ জন যুবক তার ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। হামলাকারীরা আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে দলীয় স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ।

গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ধোলাইখালের রোকনপুরের রাস্তায় প্রতিপক্ষের গুলিতে খুন হন মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের উপ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক রাজীব হাসান খান বাবু। পরে রোমান নামে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রোমান ৪২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি। এ ঘটনায় রাজীবের মা মার্জিয়া বেগম বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, পুরান ঢাকার ৪২ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি ফয়সাল আহমেদ ওরফে নাসিরকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা রাজীবের বন্ধু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। তারা বিভিন্ন সময় রাজীবের কাছে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিতেন। এ ছাড়া রাজীব সব সময় খারাপ কাজের প্রতিবাদ করতেন। এটা তারা মেনে নিতে পারেননি। এরই জেরে নাসিরের নেতৃত্বে মামলার আসামিরা রাজীবকে গুলি করে হত্যা করেছেন।

গত ১৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বালাইশপুর গ্রামের যুবলীগ নেতা মো. ফয়সলকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২৯ জুলাই বগুড়া শহরতলির ফুলতলায় যুবলীগ নেতা আকুল হোসেনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ১৫ এপ্রিল রাজধানীর আদাবরে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান রমিজকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রমিজের স্বজনরা অভিযোগ করেন, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে হত্যা করিয়েছেন। রমিজের ছোট ভাই সৈয়দ শহিদুজ্জামানকেও ২০০২ সালে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর