শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

২০ দল এখন শুধুই কাগুজে বাঘ

মাহমুদ আজহার

ডেমোক্রেটিক লীগ। ২০-দলীয় জোটের ক্ষুদ্র একটি শরিক দল। সংগঠনটির কোনো কার্যালয় নেই। সাংগঠনিক কার্যক্রমও চোখে পড়ে না। সারা দেশেও নেই কোনো অস্তিত্ব। শুধু জোটপ্রধান বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে কোনো মিটিং হলে দেখা মেলে এ দলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনিকে। সংগঠনটির বাকি নেতাদের সবাই অপরিচিত। ২০-দলীয় জোটের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, ‘জোট এখন কাগুজে। বেশকিছু দিন ধরেই জোটগত কোনো তত্পরতা নেই। তা ছাড়া জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত বেশ বেকায়দায়। তাই জোটবদ্ধ কর্মসূচিও দেওয়া হচ্ছে না। কোনো মিটিংও হচ্ছে না।’ শুধু ডেমোক্রেটিক লীগই নয়—বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দলের একই অবস্থা। অধিকাংশ দল ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর। এসব দলের নিজের আলো নেই, বিএনপি-জামায়াতের আলোয় তারা আলোকিত। সংগঠনগুলো ব্যক্তিনির্ভর। জোটের বৈঠকেই শুধু দেখা মেলে তাদের। সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি নিয়ে বা দলগতভাবে মাঠে দেখা মেলে না তাদের।  জোট এখন সক্রিয় না নিষ্ক্রিয় এমন প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘জোট এখন সক্রিয় নয়, কিছুটা ঠিক। এর সম্ভাবনাও কম। এখন আমরা দল গোছাচ্ছি। তা ছাড়া বর্ষাকাল চলছে। কোনো কর্মসূচিও নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন পবিত্র হজ পালন করে দেশে ফিরেছেন। কিছুদিন পর দল ও জোট নিয়ে তিনি কথা বলবেন। তবে রামপাল ইস্যুতেও জোটগতভাবে কোনো কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।’ ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চার দলের কলেবর বেড়ে ১৮-দলীয় জোট হয়। এই জোটে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট ছাড়া বাকি শরিকরা ছিল—খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ। পরে পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল এ জোটে যোগ দিলে তা ২০-দলীয় জোটে পরিণত হয়। ২০-দলীয় জোটের শরীক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ)। সংগঠনটির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি আর মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া। এখনো তারা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি। দলের কার্যক্রম পুরোটাই বিবৃতিনির্ভর। জেবেল রাহমান গানির বাড়ি নীলফামারী হওয়ায় সেখানে কিছু কার্যক্রম থাকলেও ঢাকাসহ সারা দেশে আর কোথাও নেই সংগঠনটির অস্তিত্ব। নেই কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও। শীর্ষ দুই নেতার বাইরে সবাই অপরিচিত মুখ। মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া জানালেন, ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর সংগঠন পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন জোটেরও কোনো কর্মসূচি নেই। জোট কার্যকর হবে কী না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ, জোটবদ্ধ কর্মসূচি দিলে জামায়াতকে নিয়ে সরকার আর বিদেশিরা নানা প্রশ্ন তোলে। এ কারণে বিএনপিও হয়তো নিজেদের মতো করেই কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। রামপাল নিয়ে আমরাও আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করছি।’ বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। এ সংগঠনেরও নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। ইরান জানালেন, ‘নিবন্ধনের চেষ্টাও তারা করেন না। এ সরকার তাদের নিবন্ধন দেবে না।’ তবে তার ৪৪টি জেলায় কমিটি রয়েছে বলে দাবি করেন। জোটের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন জোট বলতে বিএনপি আর জামায়াত। বিএনপি ডাকলে কোনো বৈঠকে যাই। না ডাকলে যাই না। ডাকলে মনে হয়, জোট সক্রিয়। শুনছি, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাদের ডাকবেন। সেই অপেক্ষাই আছি।’ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইদ আহমেদ। তিনিও তার পার্টির সব। জোটেরও অন্যতম নেতা। এ দলের নেতা-কর্মী চোখে পড়ে না। নামসর্বস্ব দলের অফিসও কাগজে কলমে। নিজেদের কোনো কর্মসূচিও নেই। জোটের দিকে তাকিয়ে থাকেন তারা। দলীয় কর্মসূচি প্রসঙ্গে সাইফুদ্দিন মনি বলেন, ‘এ সরকার বাকশালী। তাই রাস্তায় নেমে দলীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি পালনের ইচ্ছা আমাদের নেই। আর সভা-সেমিনারে বিশ্বাসও করি না। রামপাল ইস্যু নিয়েও দলীয় কোনো কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাও নেই।’ বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, জোটের নামসর্বস্ব অধিকাংশ দলই বিএনপি-প্রধানের পাশে বসে বৈঠক করেন। তারা যখন বৈঠকে বসেন, তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারাও দ্বিতীয় সারিতে বসতে বাধ্য হন। এ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে নানা সমালোচনা থাকলেও কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস পান না। জোটের এসব নেতা ওয়ার্ড পর্যায়ে নির্বাচনেও বিএনপির ওয়ার্ড প্রার্থীর কাছে জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। অথচ তারা এখন চেয়ারপারসনের পাশে বসে ফটোসেশন করেন। আর তৃণমূল নেতা-কর্মীরা চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেরও সুযোগ পান না। এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নামসর্বস্ব দল আওয়ামী লীগ জোটেও আছে। সবাই যে সমান শক্তিশালী হবে এমনও নয়। তবে যাদের নিবন্ধন নেই আমরা তাদের বলেছি, নিবন্ধন করতে। বিএনপির আলোয় অনেক দল আলোকিত এটা অনেকটাই সত্য।’ জানা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে ১২টি ছাড়া বাকি দলগুলোর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। ভাঙন আর দলাদলিতে জড়িয়ে আরও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে কয়েকটি দল। একদিকে ভাঙন, আরেক দিকে নামসর্বস্ব দল গঠনও হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে দলাদলি, সন্দেহ, অবিশ্বাস। তার পরও সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। এরই মধ্যে নানামুখী চাপ ও কিছু প্রাপ্তির লোভে ২০-দল ছেড়েছে ইসলামী ঐক্যজোট, এনপিপি ও ন্যাপ (ভাসানী)। তবে শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে এনপিপি জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও দলের নেতা ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে একটি অংশ ওই নামেই ২০-দলে থেকে যায়। এদিকে জোটের অন্যতম শরীক দল জামায়াতে ইসলামী চরম বেকায়দায় পড়েছে। দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি হয়ে গেছে। আরও কয়েক নেতার ফাঁসির অপেক্ষা। দলটির সব অফিস তালাবদ্ধ। মামলা-হামলায় কাবু নেতা-কর্মীরা এখনো আত্মগোপনে। কারাগারের বাইরে থাকা সিনিয়র কোনো নেতার দেখা মেলে না জোটের বৈঠকেও। নিম্নসারির এক নেতাকে মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও থাকেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম জানান, ‘জোটে অনিবন্ধিত নামসর্বস্ব দলগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। জোটকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে নিবন্ধিত দলগুলোকে নিয়ে আসতে হবে। কাগুজে দলের সংখ্যা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।’

সর্বশেষ খবর