রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চার অপারেশনে ১২ জঙ্গি নিহত

গাজীপুরে দুটি, টাঙ্গাইল ও সাভারে একটি বাড়িতে অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১২ জঙ্গি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের নোয়াগাঁও এলাকায় সাত, হাড়িনালে দুই, টাঙ্গাইলে দুই এবং সাভারে একজন রয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কয়েকজন সদস্যও এ সময় আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অভিযানের সময় ব্যাপক গোলাগুলি হয়। নিহতদের মধ্যে একজন হলেন আকাশ। তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জঙ্গি হামলার অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাব গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এই চার অপারেশনের বিস্তারিত তুলে ধরে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও সাভার প্রতিনিধি

চার অপারেশনে ১২ জঙ্গি নিহত

গাজীপুরের হাড়িনাল পশ্চিমপাড়া লেবু বাগান এলাকায় যৌথ অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকা, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে র‌্যাব-পুলিশের পৃথক চারটি অভিযানে গতকাল ১২ জঙ্গি নিহত হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলা এসব অভিযানে এক দিনে এত জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। গাজীপুরের পাতারটেকে ‘অপারেশন শরতের তুফান’ নামের অভিযানে সাতজন, একই জেলার হাড়িনাল এলাকার আরেকটি বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানে দুজন, টাঙ্গাইলের কাগমারায় র‌্যাবের আরেকটি অভিযানে আরও দুজন এবং সাভারের আশুলিয়ায় একজন নিহত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আশুলিয়ায় একটি বাড়িতে গতকাল র‌্যাব সদস্যরা টানা ছয় ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে জেএমবির অর্থদাতা আবদুর রহমান আয়নাল ওরফে নাজমুল হক ওরফে বাবুসহ (৩৫) তিনজনকে গ্রেফতার করেন। বাকি দুজন হলেন রহমানের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রুমি, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী তারেক। রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ অভিযান শেষ হয়। ওই বাড়ি থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ২০ রাউন্ড গুলি, নগদ ৩০ লাখ টাকা, পাঁচটি ছুরিসহ বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ জানান, সাভারের বাইপাইলে একটি পাঁচ তলা বাড়িতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব অভিযান চালায়। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ভিতরে থাকা জঙ্গি গুলি ছুড়লে আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। র‌্যাব সূত্র জানায়, আটক জঙ্গিকে প্রায় দুই বছর যাবৎ ট্র্যাকিং করে আসছিলেন র‌্যাব সদস্যরা। আবদুর রহমান কয়েক দিন পর পর বিভিন্ন এলাকায় বাসা পরিবর্তন করায় তাকে গ্রেফতার করতে বিলম্ব হয়েছে। সূত্র জানায়, গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে র‌্যাবের একটি দল আশুলিয়ার বসুন্ধরা টেক এলাকার আমির মৃধা শাহিনের বাড়িতে অভিযান শুরু করে। এ সময় র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়ির পাঁচ তলার গ্রিল কেটে লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে রহমান। লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হলে র‌্যাব সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে চিকিৎসার জন্য এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি করেন। র‌্যাব সদস্যরা বাড়ির ভিতরে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র, নগদ টাকাসহ বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করেন। এ ব্যাপারে র‌্যাব সদর দফতরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, আটক রহমান জঙ্গি কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ করতেন। এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাভারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমান জানিয়েছেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৮টার দিকে আবদুর রহমান আয়নাল ওরফে নাজমুল হক ওরফে বাবু মারা গেছেন। তাকে ধরতে র‌্যাব এর আগে চারবার অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে র‌্যাব গতকাল ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আহত অবস্থায় তাকে আটক করেছিল।

অন্যদিকে গতকাল বিকালে আশুলিয়ার পলাশবাড়ী এলাকার রানা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালায় ঢাকা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল ও আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল। এ সময় ওই বাড়ির পাঁচ তলা থেকে সোহাগ নামের এক জঙ্গিকে আটক করে পুলিশ। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাশের একটি বাড়ি থেকে জুয়েলকে আটক করা হয়। তার কাছ থেকে চাপাতি, বিদেশি অস্ত্র, গুলি, বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই ও টাকা উদ্ধার করা হয়।

এর আগে গতকাল গাজীপুরের পাতারটেক এলাকায় অভিযান শেষে ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, গাজীপুরের নোয়াগাঁও পাতারটেক এলাকায় ‘অপারেশন শরতের তুফান’ নামের অভিযানে সাত জঙ্গি নিহত হয়েছে। ওই এলাকার একটি তিন তলা বাড়িতে ওই অভিযান চালানো হয়। গতকাল সকাল থেকে বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত সেখানে অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম—সিটিটিসি ইউনিট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে তামিম চৌধুরীর পর যে নেতৃত্ব দিত, ছদ্মনাম হোক আর তাদের সাংগঠনিক হোক, তার নাম হচ্ছে আকাশ। সে এখানে নিহত হয়েছে, সেই সাতজনের মধ্যে একজন। সোয়াত, বোম্ব ডিস্পোজাল টিম, কাউন্টার টেররিজম, জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে এ অভিযান পরিচালনা করে।’ জানা গেছে, নব্য জেএমবির ঢাকা বিভাগের কমান্ডার ফরিদুল ইসলাম আকাশ ও তার সহযোগীরা সেখানে অবস্থান করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল সকালে ওই আস্তানাটি ঘিরে ফেলেন সিটিটিসির সদস্যরা। সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, অভিযান শেষে ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হয়েছে তিনটি অস্ত্র, কয়েকটি চাপাতি ও একটি গ্যাস সিলিন্ডার। গোলাগুলির মধ্যে ১৪টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছে। তবে কী ধরনের অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তত্ক্ষণাৎ সেগুলোর নাম প্রকাশ করেননি তিনি। আরও জানান, এ সময় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন সদস্য আহত হন। তার হাতে গুলি লেগেছে। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

এদিন সকালে গাজীপুরের পশ্চিম হাড়িনালে একটি বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। ওই অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত ও একে-২২সহ কিছু অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এ তথ্য দিয়ে জানান, হাড়িনালের জঙ্গি আস্তানায় নিহতদের প্রাথমিক পরিচয় মিলেছে। তারা হচ্ছে রাশেদ মিয়া ও তৌহিদুল ইসলাম। তবে বাড়িওয়ালার কাছে থাকা ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমের এ তথ্য সঠিক কিনা তা এখনো যাচাই-বাছাই চলছে। ওই বাড়ি থেকে একটি একে-২২, একটি ৯ এমএম পিস্তল, গুলিসহ আরও কিছু দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘বাড়ির মালিক আতাউর রহমানের কাছে থাকা ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম অনুযায়ী নিহতরা হচ্ছে রাশেদ মিয়া ও তৌহিদুল ইসলাম। তাদের বাড়ি নরসিংদীতে। তবে তাদের এ পরিচয় সঠিক কিনা সে ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।’ তিনি আরও জানান, বাড়িওয়ালাকে রাশেদ মিয়া জানিয়েছিল সে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে পরীক্ষা দিয়েছে কিনা সে ব্যাপারে বাড়িওয়ালা নিশ্চিত নন। আর তৌহিদুল ইসলাম গাজীপুরের জয়দেবপুরের ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি—ডুয়েটের ছাত্র ছিল। এ ছাড়াও পশ্চিম হাড়িনালের ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, একটি ৯ এমএম পিস্তল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, চাপাতি ও বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার পর আস্তানা থেকে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব-১-এর উপ-অধিনায়ক লে. কমান্ডার সোয়াইব জানান, বেলা পৌনে ১২টার দিকে ওই বাড়ির ভিতর থেকে এসব অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এর আগে গোপন সূত্রের খবরে ভোরবেলা থেকে ওই বাড়িটিতে অভিযান চালায় র‌্যাব।

কাগমারা অভিযান : টাঙ্গাইলের কাগমারার অভিযান শুরু হয় গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। সেখানে সন্দেহভাজন দুই জঙ্গি নিহত হয়। তাদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। এদের একজনের বয়স ২৫, অন্যজনের ২০ বছর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ সময় র‌্যাব সদস্য করপোরাল সাইফুল ও সৈনিক রেজাউল আহত হয়েছেন। তাদের টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

র‌্যাব-১২-এর অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহাবুদ্দিন খান জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়িটিতে সকাল ১০টার দিকে অভিযান চালানো হয়। ভিতরে ঢোকার পর এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে গেলে ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। এ সময় অন্য জঙ্গিরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার চেষ্টা চালায়। র‌্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে দুজন জঙ্গি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। তিনি জানান, দুপুর দেড়টার দিকে বোমা বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্যদের নিয়ে জঙ্গি আস্তানায় প্রবেশ করে দুই জঙ্গির লাশ ও বিপুল পরিমাণ দেশি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় নগদ ৬৪ হাজার টাকা, দুটি ল্যাপটপ, দুটি পিস্তল ও ১০টি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।

বাড়িওয়ালা আজাহার উদ্দিন মাস্টার জানান, ২৭ সেপ্টেম্বর ওই যুবকরা ছাত্র পরিচয়ে বাসার নিচ তলার একটি কক্ষ ভাড়া নেয়। তাদের কাছে ছবি ও ঠিকানা চাইলে তারা জানায় দু-এক দিনের মধ্যেই দেবে। এরই মধ্যে আজ (শনিবার) র‌্যাব সদস্যরা বাসায় এসে জিজ্ঞাসা করতেই র‌্যাবের এক সদস্যকে রুমের বাইরে থাকা জঙ্গিরা জাপটে ধরে। তাদের মধ্যে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয়। পরে র‌্যাবের ওপর অন্য জঙ্গিরা বাসার ভিতর থেকে গুলি চালায় এবং র‌্যাবও গুলি চালায়।

সর্বশেষ খবর