বুধবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

উদারপন্থিদের প্রভাব কমছে বিএনপিতে

মাহমুদ আজহার

উদারপন্থিদের প্রভাব কমছে বিএনপিতে

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে ‘উদারপন্থি’ খ্যাত অন্তত ৯ জন সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা থাকলেও দলের ভিতরে-বাইরে এসব নেতা এখন কোণঠাসা। সর্বশেষ দলের নির্বাহী কমিটি ঘোষণায় উদারপন্থি এসব নেতার তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। অন্যদিকে জয়জয়কার ছিল ‘অতি’ ডানপন্থিদের। পুরো বিএনপিই এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। জানা যায়, বিএনপির সর্বস্তরের কমিটিতে অতি  ডানপন্থিরাই এখন সক্রিয়। দলের নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা সাংগঠনিক কার্যক্রমে তারাই এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেও একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এরপরও দলে মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের প্রভাব কম। দল এখন ক্রমেই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। ডানপন্থি ও বামপন্থিদের নেতৃত্বে ভারসাম্য হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।  এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপিতে উদারপন্থি বা কট্টরপন্থি বলে কিছু নেই। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়া বিএনপির গঠনতন্ত্রেই আছে, বিএনপি উদারপন্থি গণতান্ত্রিক দল। এখানে কে ডান কে বাম তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা সবাই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আস্থাশীল। বিএনপিবিরোধী শক্তি এ ধরনের ভাগ করছে।’

অবশ্য গণস্বাস্থের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার সময় বিএনপিতে উন্মুক্ত চিন্তা-চেতনা লালন করা যেত। কিন্তু বিএনপি আজ জিয়ার সেই আদর্শে নেই। দলের গঠনতন্ত্রই তারা মানছে না। নিজ দলেই গণতন্ত্রচর্চা হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের বিশেষ করে আবদুল্লাহ আল নোমান বা মেজর হাফিজের (অব.) মতো নেতাদের স্থায়ী কমিটিতে নেওয়া হলো না। সেটাও অনেকেরই প্রশ্ন। আবার মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরীকে বিদায় নিতে হলো কেন— তাও খতিয়ে দেখা দরকার। আমি মনে করি, মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের বিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা উচিত। নেতৃত্বে ভারসাম্য থাকা জরুরি।’ বিএনপিতে জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল চিন্তার বিশ্বাসীদের অনেকেই এখন ‘কোণঠাসা’। আবার সংস্কারপন্থি অংশের অধিকাংশই প্রগতিশীল বলয়ের। ক্ষুদ্র একটি অংশের দলে জায়গা হলেও তাদের বড় অংশই এখনো বাইরে। ফলে দলের ভিতরেও অসন্তোষ বাড়ছে। সর্বশেষ কাউন্সিলের পর দলে ঢাউস কমিটি করেও ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রশমন করা যায়নি। দলের কয়েকজন নেতা পদত্যাগও করেছেন। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ায় একটি অংশ নিষ্ক্রিয় থাকার চিন্তাভাবনা করছে। এ অংশের নেতাদের বেশির ভাগই উদারপন্থি। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, দুই ধারার নেতা নিজেদের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দলকে বিপদে ফেলছেন। অনেক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিএনপি। অনেক ক্ষেত্রে দলের নীতিনির্ধারকদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। এ কারণেই যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে বিএনপি কার্যত কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি। জামায়াত নিয়েও দলের অবস্থান পরিষ্কার নয়। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় দলের করণীয় নির্ধারণ করতে পারেনি। এতে দলের শক্তি সঞ্চয়ের পরিবর্তে দিন দিন ক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। জানা যায়, আদর্শিক প্রভাব পড়েছে বিএনপির নির্বাহী কমিটিতেও। স্থায়ী কমিটির বাইরে ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায়ে অতি ডানপন্থিদেরই আধিক্য বেশি। উদারপন্থি বা বাম আদর্শের নেতারা অনেকাংশে উপেক্ষিত। কমিটিতে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত। বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, উপদেষ্টা পর্যায়ে কয়েকজন জামায়াতের সরাসরি সমর্থকও। জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন এমন নেতাও রয়েছেন বিএনপির কমিটিতে। যুদ্ধাপরাধী নেতার ছেলেদেরও কমিটিতে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপিতে একটি ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে যারা চীনপন্থি। অবশ্য এসব নেতাও বাম বলয়ের। তারা দলের মূল আদর্শের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবল সমর্থক বলে মনে করা হয়। বিএনপির মধ্যসারির ‘উদারপন্থি’ একাধিক নেতা জানান, দীর্ঘদিন ধরে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, মেজর হাফিজউদ্দিন আহমদ (অব.), শাহ মোয়াজ্জেমের মতো নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি নতুন কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান হওয়া বিএনপির উদারপন্থি নেতা মো. শাহজাহানও স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পাননি। দলের দুঃসময়ে তিনি খাদের কিনার থেকে বিএনপিকে তুলে আনতে ভূমিকা পালন করেছেন। এ নিয়ে দলের তরুণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। এসব নেতা বলছেন, বিএনপির বিদায়ী ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীও একজন মুক্তিযোদ্ধা। দলের ভিতরে তিনিও নানাভাবে কোণঠাসা ছিলেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।  এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান নেওয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেন, ‘কমিটিতে আমাকে কোথায় রাখা হয়েছে, তা নিয়ে ক্ষোভ নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন যেখানে ভালো মনে করেছেন, সেখানেই রেখেছেন। বিএনপি একটি উদার রাজনৈতিক দল। এখানে ডান-বাম সবাই রয়েছেন। তবে সবাই এখন মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়ার আদর্শে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে কাজ করছেন। এত বড় একটি দলে মতপার্থক্য থাকবেই। এটাই একটি দলের সৌন্দর্য এবং গণতান্ত্রিক চর্চার বহিঃপ্রকাশ।’

সর্বশেষ খবর