চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের সহযোগিতা ও অংশীদারি অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করবে বলে প্রত্যাশা করছে ঢাকা-বেইজিং। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ঋণ-সহায়তার চুক্তি হতে পারে এ সফরে। টাকার অঙ্কে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলারের এই ঋণ বাংলাদেশের চলতি বাজেটের সমান। শুধু তা-ই নয়, সফরে কমপক্ষে ২০টি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে দুই দেশ। এর অর্ধেক ঋণ সহযোগিতা ও অর্ধেক হবে নীতিবিষয়ক। প্রস্তাবিত চুক্তিগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্মোচিত হবে নতুন দিগন্ত। চীন থেকেই আসবে বিশাল বিনিয়োগ। সুযোগ তৈরি হতে পারে চীনের অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির সরাসরি সংযোগের। এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে বিশেষ বার্তা থাকবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। চীনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা কূটনীতিক মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘চীনের কোনো রাষ্ট্রপতি যখন কোনো একটি উন্নয়নশীল দেশে সফর করেন, তখন একটি বড় অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করে থাকেন। সফর ঘিরে তৈরি হয় আলোড়ন। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ সফরের সময় এর ব্যতিক্রম হবে না। এ সফরের সময় অনেকগুলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। একটি বড় প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে। বাংলাদেশ যতটুকু সহায়তা নিতে পারবে, ততটুকুই দেবে চীন।’ চীনে বাংলাদেশের অপর সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমানের মতে, ‘চীনের কাছে প্রত্যাশা বাংলাদেশের অনেক। চীনকে আমরা সব সময় পাশে চাই। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই সফর শুধু একটি বন্ধুদেশের প্রেসিডেন্টের সফর নয়, এটি আরও বাড়তি কিছু।’ কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ১৯৮৬ সালে চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লি শিয়াননিয়ান ঢাকা সফর করেছিলেন। এর ৩০ বছর পর এখন ২০১৬ সালে এসে দ্বিতীয় চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঢাকা সফর করতে আসছেন শি জিনপিং। ঢাকায় থাকবেন মাত্র ২২ ঘণ্টা। এর মধ্যে বৈঠক করবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। অবশ্য ঢাকা-বেইজিং কূটনৈতিক সম্পর্কের চার দশক পূর্তি উপলক্ষে গত বছরই ঢাকায় আসার কথা ছিল চীনা প্রেসিডেন্টের। তবে বিভিন্ন কারণে সফর পিছিয়ে যায়। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রেখে আজ আসছেন জিনপিং। ইতিমধ্যে চীনের নতুন প্রজন্মের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া শি জিনপিং এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও উদ্যোগী। বাংলাদেশ সরকারও চীনমুখী অর্থনীতিতে মনোযোগী। চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ব্রিকস ব্যাংকেও যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যান্য চীনা উদ্যোগের বিষয়েও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছে সরকার। আর চীনের এই প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশও অপরিচিত কোনো রাষ্ট্র নয়। তিনি ২০১০ সালে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে একবার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। আর ২০১৪ সালের জুনে শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় দুই দেশ ‘সহযোগিতার জন্য নিবিড় সমন্বিত অংশীদারত্ব’ প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়েছিল। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। এ জন্য এখন থেকেই বড় ধরনের অবকাঠামো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু এত সব মেগা প্রকল্পের জন্য অর্থের সংস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য। এসব প্রকল্পের বিষয়ে চীনকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এবার সেই প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার পথে। চলতি মাসের শুরুতেই বিশাল অঙ্কের ঋণের জন্য চীনের কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের তালিকা পাঠায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২১ প্রকল্পের জন্য ঋণচুক্তি হতে পারে। এর মধ্যে রেল খাতের চারটি, সড়ক পরিবহনের চারটি, বিদ্যুতের চারটি, জীবনমান উন্নয়নে পাঁচটি, জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি করে এবং শিল্প খাতের দুটি প্রকল্প রয়েছে। শুধু অর্থ সহায়তার বিষয়ে নয়, চীনের প্রেসিডেন্টের সফর বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ। বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নানা পদক্ষেপ এবং সমুদ্র যোগাযোগ স্থাপনে চীনের উদ্যোগগুলোর প্রেক্ষিতেও বাংলাদেশ সফর গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ সফরে গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে কোনো ঘোষণা নাও আসতে পারে বলে ইঙ্গিত এসেছে ঢাকার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিনপিং একান্তে যে কথা বলবেন, এটা নিশ্চিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে আমাদের পাওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। আবার দেওয়ারও রয়েছে। এর প্রধান কারণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। চীনের কুনমিং থেকে বেইজিং যেতে উড়োজাহাজে যেখানে তিন ঘণ্টা লাগে, সেখানে আমাদের চট্টগ্রাম আসতে লাগে দুই ঘণ্টা। এত কাছের দুটি দেশ। আমাদের সমুদ্র আছে, সমুদ্রবন্দর আছে এবং সেই সুবিধা বাড়ানোর সুযোগ আছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের বন্দর হচ্ছে ওয়ার্ম ওয়াটার বন্দর। বাংলাদেশের এই যে সম্ভাবনা, তা চীনের জন্যও বড় সম্ভাবনা। আমরা যদি আমাদের এই ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারি, তবে আমাদের জন্য তা যেমন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি এনে দেবে, তেমনি লাভবান হবে চীনও। ফলে বন্দর বা যোগাযোগের যে সুবিধাগুলো চীনের জন্য লাভজনক হবে, তা কাজে লাগিয়ে আমরাও লাভবান হতে পারি। এসবই চীনের পক্ষ থেকে আমাদের কাছ থেকে চাওয়া।’ সাবেক রাষ্ট্রদূত লিয়াকত আলী চৌধুরীর মতে, তিনটি দেশ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য সবচেয়ে জরুরি। দেশগুলো হলো ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের অবদানের কারণে ঢাকার কাছে বেইজিং বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সক্ষমতা ও আগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশকে সহায়তা দেওয়ার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন এবং ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়বে। বেইজিং তার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশকে আস্থায় নেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, চীন তা-ই করবে। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশে বড় আকারে বিনিয়োগ করার আগ্রহও জানিয়েছে। তবে চীন অত্যন্ত বাস্তববাদী এবং বাংলাদেশ চায় না, এমন কোনো কিছুর জন্য তারা আমাদের বলবে না। চীন তার অবস্থান সংহত করার চেষ্টা ঠিকই করে, কিন্তু যদি তারা বুঝতে পারে, এর ফলে অন্যদের সমস্যার কারণ হচ্ছে, তাহলে তারা বিষয়টি নিয়ে জোরাজুরি করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, “তিন দশক আগের চীন আর ২০১৬ সালের চীন এক নয়। তারা এখন বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার পথে অগ্রসরমাণ। আর বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সীমান্তের দূরত্ব যেখানে মাত্র ৯০ মাইলের, তাই দেশটিকে আমাদের ‘প্রায় প্রতিবেশী’ই বিবেচনা করা যায়। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন মানে যে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি নয়, এটি বাংলাদেশের অন্য দেশগুলোকে বোঝাতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের সুযোগ ও সম্ভাবনা দুই-ই বাড়বে।”