শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাণিজ্য ঘাটতি কমবে কি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। দুই দেশের মধ্যে ফি-বছর প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে এ বাণিজ্যের পরিমাণ। তবে হতাশার কথা হচ্ছে, দুই দেশের এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক থেকে বাংলাদেশ সুবিধা নিতে পারছে খুব কম ক্ষেত্রেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে নিচ্ছে চীন। অন্যদিকে চীনে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় এক বিলিয়ন ডলারেরও কম। বৃহত্তম এই বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য-ঘাটতি তাই গলার কাঁটার মতোই অস্বস্তিকর বাংলাদেশের জন্য। তবে আশার কথা, এখন উভয় পক্ষই চাইছে বাণিজ্য-ঘাটতি কমিয়ে আনতে। চীনের দিক থেকে কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। দুদিনের সফরে আজ ঢাকায় আসছেন চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং। প্রশ্ন হচ্ছে, মহাচীনের প্রেসিডেন্টের এই সফরে দুই দেশের মধ্যে যে বিপুল বাণিজ্য-ঘাটতি, সেটি কি কমানোর কোনো উদ্যোগ থাকবে? এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক সেমিনারে বলেছেন, চীনের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পণ্যের রপ্তানি ২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া চীন তার তৈরি পোশাক শিল্পের বিনিয়োগ স্থানান্তর করতে চাইছে। সরকার যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, এর মধ্যে একটি চীনকে দেওয়া হবে। চীনের বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সব ধরনের সহযোগিতা করবে। এটি সত্য যে চীনের তৈরি পোশাক খাতের একটি অংশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে সেটি যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করবে, তেমনি রপ্তানি বাড়াতেও রাখবে বড় ভূমিকা। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নত দেশগুলোতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজারসুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের উপযোগী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এখানকার শ্রমের খরচও তুলনামূলকভাবে কম। এই সুবিধাগুলো নিতে চাইছেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। তাই বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়লে কেবল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য-ঘাটতি কমবে তা নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।  বিনিয়োগের বাইরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে নীতিগত সুবিধা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। ২০১৩ সাল থেকে চীন তার বাজারে বাংলাদেশকে ৯৫ শতাংশ পণ্যে শুল্কসুবিধা দিয়ে আসছে। তবে চীনের এই স্কিমে দেশের প্রধান প্রধান রপ্তানিপণ্য না থাকায় দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে চীনে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া, মাছ ও কাঁকড়া, প্লাস্টিক পণ্য, ফুল, সবজি, ফল, মসলা, তামাক ইত্যাদি। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রক্রিয়াজাত চামড়ার ৬০ শতাংশের বেশি রপ্তানি হয় চীনে। এ ছাড়া অপ্রক্রিয়াজাত চামড়ারও বড় একটি অংশ যায় দেশটিতে। অন্যদিকে বর্তমানে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক উৎপাদকরা সারা পৃথিবীতে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে থাকেন। এর মধ্যে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয় চীনে। সে ক্ষেত্রে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং রুলস অব অরিজিনের শর্ত শিথিল করা হলে দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বাণিজ্যসুবিধা নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন বাংলাদেশের জন্য দুই ধরনের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। একটি হচ্ছে, চীনের কাছে বর্তমানে বাংলাদেশ আপটা ও ‘জিরো ট্যারিফ’ এই দুটি স্কিমে বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে আসছে, চীন চাইছে দুটো সুবিধা কার্যকর না রেখে আপটা বাদ দিয়ে ‘জিরো ট্যারিফ স্কিমে’ বাণিজ্যসুবিধা বহাল রাখতে। এর বাইরে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করারও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এমনকি এফটিএ করার প্রস্তাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার পরও পিছু হটেনি দেশটি। তারা গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবার এ বিষয়ে চিঠি লিখে বলেছে, দ্বিপক্ষীয় এফটিএ করার বিষয়টি থেকে বাংলাদেশ যেন সরে না আসে। অন্তত একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে তাদের প্রস্তাবটি যেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে চীনের প্রস্তাব দুটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে। এতে বাংলাদেশের বাণিজ্যসুবিধার লক্ষণ স্পষ্ট নয়। সে কারণে এ দুটো প্রস্তাবের কোনোটাই চায় না বাংলাদেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে চীনে আপটার আওতায় ৮৩টি পণ্যে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার জিরো ট্যারিফ স্কিমের আওতায় ৪ হাজার ৭৮৮টি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। আপটার আওতায় শুল্কসুবিধার ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে ৩৫ শতাংশ এবং জিরো ট্যারিফের আওতায় ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত রয়েছে। চীনের প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ আপটা বাদ দিয়ে জিরো ট্যারিফ স্কিমে বাণিজ্যসুবিধা নিতে গেলে রুলস অব অরিজিনের শর্ত মেনে রপ্তানিপণ্যে ৪০ শতাংশ হারে স্থানীয়ভাবে মূল্য সংযোজন করতে হবে। ফলে এখানে আপটায় যে সুবিধা আছে, এর চেয়ে বেশি শর্ত রয়েছে। আবার দ্বিপক্ষীয় এফটিএ করলে বাংলাদেশের চেয়ে চীনের লাভ বেশি। কারণ চীন বাংলাদেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করবে বিনা শুল্কে। বিপরীতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ হবে এক বিলিয়ন ডলারেরও কম। আবার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে, সেটি থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থায় চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপেংয়ের কাছে বাংলাদেশ কী চাইবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ চীনের কাছে চাইছে শতভাগ শুল্কসুবিধা। নিদেনপক্ষে সেটি না হলেও যেন আপটা ও জিরো ট্যারিফের আওতায় রুলস অব অরিজিনের যে শর্ত রয়েছে তা কিছুটা শিথিল করে চীন। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য-ঘাটতি কমাতে এটিই এখন দাবি বাংলাদেশের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর