শিরোনাম
শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নতুন ইতিহাসে বাংলাদেশ-চীন

নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন ইতিহাসে বাংলাদেশ-চীন

নিজ কার্যালয়ে গতকাল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —পিআইডি

নতুন ইতিহাসে বাংলাদেশ-চীন। ব্যবসা-বাণিজ্য, সমুদ্র সহযোগিতা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিভিন্ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে দুই দেশ। এর মধ্যে ১৫টি সমঝোতা স্মারক ও ১২টি ঋণ ও রূপরেখা চুক্তি। একই সঙ্গে উদ্বোধন করা হয়েছে ৬ প্রকল্পের। কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ দেবে বিভিন্ন খাতে। এর বেশির ভাগই অবকাঠামো খাত। গতকাল চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আগে দুই নেতা একান্ত বৈঠক করেন এবং দুই দেশের প্রতিনিধি দল দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে তাদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

শি জিনপিং বলেন, আমরা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের জায়গা থেকে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছি। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ সফরে আসেন। পরে তিনি বিকাল ৩টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শিমুল কক্ষে একান্ত বৈঠকে অংশ নেন দুই নেতা। পরে চামেলি কক্ষে দুই দেশের প্রতিনিধিরা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৈঠকে বসেন।

‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতি ধরে এগিয়ে যাওয়া চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে শি জিনপিংয়ের এই ঢাকা সফর। ১৯৮৬ সালে লি শিয়ানইয়ানের পর বাংলাদেশে আসা প্রথম চীনা রাষ্ট্রপ্রধান তিনি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এ সফরকে সম্পর্কের ‘নতুন যুগের সূচনা’ বলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২৭ সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষর : চীনা প্রেসিডেন্টের ‘ঐতিহাসিক’ বাংলাদেশ সফরে ‘সফল’ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের ‘নতুন দিগন্ত’ উন্মোচিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। গতকাল চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব এ কথা বলেন। শি জিনপিংয়ের এ সফরের মধ্য দিয়ে চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ‘কৌশলগত সম্পর্কে’ উন্নীত হয়েছে বলে তিনি মন্তব?্য করেন। সচিব জানান, সহযোগিতা এগিয়ে নিতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের সরকারের মধ্যে ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক এবং ১২টি ঋণ ও রূপরেখা চুক্তি হয়েছে। তবে ঋণচুক্তির আর্থিক পরিমাণ ও বিস্তারিত জানতে কয়েক দিন লাগবে বলে জানান তিনি। ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে’ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ‘সফল’ হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, চীনের রাষ্ট্রপতির সফর ঐতিহাসিক, দুই দেশের মধ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিকতা আরও বিস্তৃত ও গভীর হবে, ব্যাপ্তি বাড়বে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এখন কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে আমরা সম্পর্কের নতুন অবয়ব দেখব।

বৈঠকে উঠে আসা বিষয়গুলোর ‘রাজনৈতিক দিক রয়েছে’ মন্তব্য করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আগামীতে বিভিন্ন পর্যায়ে দুই দেশের সফর দেখা যাবে। ট্রেড ও ইনভেস্টমেন্টে নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। আইসিটিতে নতুন ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়ে আলোচনা ও একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প ও পাটে বিনিয়োগের ইঙ্গিত দিয়েছে চীন। উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ যে উন্নয়ন করেছে সেখান থেকে চীনের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। দুই নেতা জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে একসঙ্গে কাজ করতেও একমত হয়েছেন বলে পররাষ্ট্র সচিব জানান। তিনি বলেন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও তথ্য আদান-প্রদানে এমওইউ হয়েছে।

৬ প্রকল্প উদ্বোধন : গতকাল বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আনুষ্ঠানিকভাবে ৬টি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী মাল্টিলেন টানেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বাংলাদেশ ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার, পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট থারমাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াটের থারমাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড।

চুক্তি ও সমঝোতায় যারা স্বাক্ষর করলেন : নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে চুক্তিপত্র ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পক্ষ থেকে করা হয় কর্ণফুলী টানেল, দাশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এবং ৬টি জাহাজ ক্রয় সম্পর্কিত মোট ৪টি ঋণচুক্তি ও সন্ত্রাস দমনে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতায় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। চীনের পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অনুষ্ঠানে স্বাক্ষরিত ১৯৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের অর্থনৈতিক চুক্তি বিনিময় হওয়া প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চায়না ইকোনমিক জোন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রশস্ত করা এবং হ্যালো চায়না ব্রডকাস্টিং লাইসেন্স প্রটোকল। আর বন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও টিভি স্টেশন শক্তিশালী করতেও হয়েছে ৪টি সমঝোতা। এ ছাড়া সমুদ্রসীমা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার লক্ষ্যে আরও ৬টি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়।

সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বে বাংলাদেশ-চীন একমত : বাংলাদেশ ও চীন পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান গভীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। এ ছাড়াও দুই দেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। খবর : বাসস।

গতকাল বিকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক জানান, চীনের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আরও গভীর এবং সম্প্রসারিত করার পাশাপাশি একে একটি নতুন অবয়ব প্রদানে একমত হয়েছেন। সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত এই দ্বিপক্ষীয় বৈঠককে অত্যন্ত ফলপ্রসূ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফরকে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে শহীদুল হক বলেন, এই সফরের ফলে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তিনি বলেন, দুই নেতাই এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। আগামী দিনগুলোতে দুই দেশের মধ্যে আরও উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময় হবে বলেও পররাষ্ট্র সচিব অভিমত ব্যক্ত করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বিষয়ে দুই নেতার আলোচনা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক অনেক পুরনো। তবে চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফরের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ করে আইসিটি খাতে সহযোগিতার ক্ষেত্রে আরও নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও পারস্পরিক সহযোগিতা আরও গভীর এবং সম্প্রসারিত হবে।

সর্বশেষ খবর