রবিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভারতীয় মিডিয়ার চোখে জিনপিংয়ের সফর

প্রতিদিন ডেস্ক

বাংলাদেশের সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নে সহজ শর্তে প্রতিবেশী দেশ ভারত দুই বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করেছিল গত বছর। এর জবাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করল চীন। ভারতের এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে গিয়ে সহজ শর্তে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশকে ভারতের চেয়েও বেশি ঋণ দিচ্ছে চীন। সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া স্টাডিজের পরিচালক জাও গানচেং বলেন, ‘ভারত ও চীন উভয় দেশই বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়, যা অন্য কেউ চাইত না বা চাইছে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ও চীন কোনো খেলায় মেতেছে। কারণ চীন ও ভারতের বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ।’ এনডিটিভির ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলারের এ ঋণচুক্তি সই করেন। এটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাওয়া সর্বোচ্চ বিদেশি ঋণ। এ ঋণের টাকা বাংলাদেশ জ্বালানি প্লান্ট, সমুদ্রবন্দর ও রেলওয়ে নির্মাণে ব্যয় করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত বাংলাদেশে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে ৩০ বছরের মধ্যে কোনো চীনা প্রেসিডেন্ট প্রথম বাংলাদেশ সফর করলেন, যেখানে ভারতও তাদের প্রভাব বিস্তার করতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া জাপানও বাংলাদেশের উন্নয়নে যুক্ত রয়েছে। বিশেষ করে বন্দর ও জ্বালানি কমপ্লেক্স নির্মাণে জাপান কম সুদে ঋণ দিচ্ছে। ফলে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের কমপক্ষে ২৫টি প্রকল্পে চীন অর্থায়ন করতে চায়, যার মধ্যে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুেকন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ বেশি। এম এ মান্নান রয়টার্সকে বলেন, ‘কম সুদে রেকর্ড পরিমাণ (২৪ বিলিয়ন ডলার) ঋণচুক্তি সই করায় শি জিনপিংয়ের সফর একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন অন্যতম।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অবকাঠামো সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের অনেক ঋণ দরকার।’ এদিকে চীনা প্রেসিডেন্টের এ সফরে বিদ্যুৎ গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ চীনের জিয়াংসু ইস্টার্ন কোম্পানির সঙ্গে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি সই করেছে। চীনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ বেশি, যে প্রস্তাবটি এক বছর ধরে আটকে আছে। এনডিটিভির প্রতিবেদনে জানানো হয়, চীনের প্রেসিডেন্ট এমন এক সময় এশিয়া সফরে বের হয়েছেন, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে আনন্দবাজার তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর বোধহয় ‘রাজনৈতিক কূটনীতির’ পাশাপাশি চীনের শক্তিশালী ‘অর্থনৈতিক কূটনীতির’ বার্তা দিয়ে অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। কারণ সত্যিকার অর্থেই পরিসংখ্যান বলছে, এর আগে অন্য কোনো নেতার সফরের সময় এত বিপুল বিনিয়োগের ঘনঘটা ঘটেনি। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে ২০০ কোটি ডলারের এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সফরকে কেন্দ্র করে ৬০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। আর এবার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির শক্তির নেতা জিনপিং ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের’ সম্প্রসারণের ভিত্তিতে সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনার যে ঘোষণা দিলেন, তাতে প্রায় ২৪০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ বাণিজ্যের প্রতিশ্রুতি পেল ঢাকা। শুক্রবার চীনা নেতার সফরের প্রথম দিনে করা ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের ফলেই আসবে এই অর্থ। আনন্দবাজার  লিখেছে, এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও চীন দুই দেশই নিজেদের গভীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ‘কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একযোগে কাজ করার ব্যাপারেও একমত হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ শহীদুল হক বলেছেন, “চীনের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের মাধ্যমে আরও গভীর এবং সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি একে একটি নতুন অবয়ব প্রদানে একমত হয়েছেন।” এ সফরকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জিনপিং ২০১০ সালে প্রথমবার ঢাকা সফরে এসেছিলেন। তখন তিনি ছিলেন চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এর আগে চীনা নেতাদের মধ্যে সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েননিয়েন ১৯৭৮ সালে একবার ঢাকা সফরে এসেছিলেন। এরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে লি ১৯৮৬ সালে আরও একবার বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এটিই ছিল সর্বশেষ কোনো চীনা রাষ্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ সফর। অবশ্য স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালে একবার ঢাকা সফরে এসেছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট লিউ শাওচি। এসবের মধ্য দিয়ে চীন-বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ বন্ধুত্বের পথরেখা তৈরি হয়। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে তৈরি হয় শক্তিশালী বাণিজ্যিক ভিত্তি। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্টের সফর ঘিরে সেই বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ভিত্তিকেই আরও এগিয়ে নেওয়ার আশা দেখেছিল বাংলাদেশের রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী মহল। এর প্রভাব কত দূর পড়বে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। বর্তমান পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ প্রায় ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য চীন থেকে আমদানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ দেশটিতে রপ্তানি করে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের পণ্য। কম্বোডিয়া সফর শেষে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শুক্রবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছান। ৩০ বছরের মধ্যে চীনের কোনো প্রেসিডেন্ট প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করলেন। এরপর সপ্তাহব্যাপী ব্রিকস সম্মেলনে অংশ নিতে শনিবার তিনি ভারতের গোয়ার উদ্দেশে রওনা হন।

সর্বশেষ খবর