বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সবার চোখ কাউন্সিলে

বিএনপিসহ সব দল, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী তাকিয়ে আওয়ামী লীগের পরবর্তী কমিটির দিকে

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

সবার চোখ কাউন্সিলে

আওয়ামী লীগের কাউন্সিল উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোকসজ্জা। নৌকার আদলে মঞ্চ তৈরিতে গতকাল শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা — রোহেত রাজীব

কাল বাদে পরশু দেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল। রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুই দিনব্যাপী এ কাউন্সিলের দিকে এখন সবার চোখ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কারা আসছেন তা নিয়ে সর্বত্রই চায়ের কাপে ঝড় উঠছে। নেতৃত্বে চমকের অপেক্ষায় দলের নেতা-কর্মীরা। বিএনপির প্রত্যাশিত চোখও কাউন্সিলের দিকে। নতুন নেতৃত্বের কাছে গণতন্ত্রের আশা তাদের। ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিরাও তাকিয়ে আছেন আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্বের দিকে। কাউন্সিল ঘিরে প্রত্যাশা অন্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদেরও। আওয়ামী লীগের সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করছে দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহলও। সভাপতি পদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকছেন— এটা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডিয়াম সদস্য, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য বা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে কারা আসছেন, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে দলের ভিতরে-বাইরে। এদিকে কাউন্সিল ‘কাছ থেকে দেখা’র জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক-নেতা-কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীর অনেকেই এখন ঢাকার পথে। এর আগেও আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়েছে। এবারের কাউন্সিল যেন আলাদা। সারা দেশে সাজসাজ রব। কেবল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলই নয়, কাউন্সিল নিয়ে এখন সরব আলোচনা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও। কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্ব কেমন হবে, তা নিয়ে আগ্রহের যেন শেষ নেই। কাউন্সিল হচ্ছে ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কিন্তু এর ঢেউ বইছে সারা দেশে। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর মধ্যে এখন প্রাণচাঞ্চল্য। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থেকে কাউন্সিল করে তখন সেই কাউন্সিল অপেক্ষাকৃত বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব। আওয়ামী লীগ এবার যে জাতীয় কাউন্সিল করতে যাচ্ছে তা জাঁকজমকের দিক থেকে অতীতেরগুলোর চেয়ে শুধু বড়ই নয়, আয়োজনের দিক থেকে আড়ম্বড়পূর্ণ ও বিশাল। তবে জাতীয় জীবনে একটি রাজনৈতিক দলের ভূমিকা জাঁকজমক দিয়ে বিচার্য নয়। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সম্মেলনে কী নীতিমালা গৃহীত হলো তার ওপর নির্ভর করে সেই কাউন্সিলের গুরুত্ব।’ দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই এবারের সম্মেলন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলের সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ যে রূপরেখা তুলে ধরবে, তার নিরিখেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করা হবে। ঘোষণাপত্রের সঙ্গে এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ৭৩ সদস্য থেকে বাড়িয়ে ৮১ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে গতিশীল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে কমিটিতে বেশকিছু পরিবর্তন আনতে পারেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর নাতি সজীব ওয়াজেদ জয়, রাদওয়ান সিদ্দিক ববি, সায়মা হোসেন ওয়াজেদ পুতুল ও বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা কাউন্সিলর মনোনীত হয়েছেন। এ নিয়েও নেতা-কর্মীসহ উত্সুকদের কৌতূহলের শেষ নেই। এবারের কাউন্সিলের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার’। সম্মেলনকে স্মরণকালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা চলছে। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশের কার্যালয়, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে। রাজধানীজুড়েই এখন সম্মেলনের আমেজ। সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে তার যে ইতিহাস, গৌরব ও ঐতিহ্য রয়েছে তা নতুনদের মধ্যে উপস্থাপন করে। দলের নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হয় এ সম্মেলনে। আগামী দিনগুলোয় আওয়ামী লীগ কীভাবে পরিচালিত হবে, দেশের মানুষের কাছে তাদের দেশ নিয়ে ভাবনাচিন্তার কথাও ঘোষণা করা হবে সম্মেলনে। এবারের সম্মেলনে জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে বিগত সময়ে সরকারের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও তুলে ধরা হবে ভিশন বাস্তবায়নের রূপরেখা। জানা যায়, নেতৃত্বে চমক আনবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কাউন্সিলে নেতৃত্ব সাজানো হবে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে। বিগত দিনে যারা কমিটিতে থেকে দলকে সংগঠিত করতে পারেননি, বরং নানা কারণে দলের অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তাদের কপাল পুড়তে পারে। স্থান পেতে পারেন ছাত্রলীগের সাবেক ত্যাগী নেতারা। এ ছাড়া রাজনীতিবিদ না হলেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি রাখা হতে পারে মূল নেতৃত্বে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কাউন্সিলের মাধ্যমে আগামী দিনের জন্য আওয়ামী লীগে শক্তিশালী ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন হবে। অতীতের মতো এবারও একটি উৎসবমুখর পরিবেশে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ যখন যে সিদ্ধান্ত নেয় তা বাস্তবায়ন করে। দেশ পরিচালনায় আমাদের যে অঙ্গীকার তা এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হবে।’ আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কাউন্সিলের আয়োজন হলে একদিকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হবে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে। এতে সার্বিকভাবে দলীয় প্রধান শেখ     হাসিনার হাত আরও বেশি শক্তিশালী হবে। আর এ চিন্তা থেকেই অতীতের যে কোনো কাউন্সিলের চেয়ে এবারের সম্মেলনে ভিন্ন মাত্রা আনা হচ্ছে। নেতা-কর্মী ছাড়াও থাকবেন কাউন্সিলর, দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বিশেষ ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, ডেলিগেটসসহ নানা পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। গতকাল কাউন্সিলস্থল ঘুরে দেখা গেছে, যে মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের রাজনীতির ঐতিহ্য বহন করে। মঞ্চের উচ্চতা হচ্ছে ২৫ ফুট। মঞ্চের পেছনে ৩৫ ফুট উচ্চতার এলইডি পর্দা। মঞ্চের সামনের দিকে ২৩০ ফুট/১২৫ ফুটের খুঁটিবিহীন কাচের মঞ্চ থাকবে। কাউন্সিলের জন্য নৌকা আকৃতির মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি দলের সম্মেলনের দিকে। নেতা-কর্মীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-আমেজ বিরাজ করছেন। একই বক্তব্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকেরও। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। এ দলটি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই দলের জাতীয় সম্মেলনে সবার দৃষ্টি থাকবে— এটাই স্বাভাবিক।’

পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপিও : আওয়ামী লীগে কেমন নেতৃত্ব আসে, কোনো চমক থাকছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি। দলটির প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগ নতুন কাউন্সিল করে দেশে ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে’ আনবে। কাউন্সিলে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে— বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে বিএনপি জানায়, তারা এখনো কোনো আমন্ত্রণ পায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে দাওয়াত পেলে দলের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে বলে জানা গেছে। গত রাত ৮টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধি দল কোনো আমন্ত্রণ নিয়ে যায়নি। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কাউন্সিলে আমন্ত্রণ পেলে তারা যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের সফলতা কামনা করে তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করি, তাদের এ সম্মেলন সফল হবে। একই সঙ্গে এও প্রত্যাশা, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে তারা ভূমিকা পালন করবেন। বিএনপি শুধু নয়, দেশের মানুষেরও প্রত্যাশা— গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবেন।’

অন্যান্য দলের চোখও কাউন্সিলে : শনিবার শুরু হওয়া দুই দিনের কাউন্সিলের দিকে চোখ রাখছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও বাইরে থাকা দলগুলোও। সবারই প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষায় আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘কাউন্সিলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দেবে এমনটাই ভাবছি। কারণ এই দলের নেতৃত্ব দেবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার কাছে দলীয় নেতা-কর্মীদের যেমন প্রত্যাশা আছে, তেমন দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা আছে জাতীয় উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার। শেখ হাসিনাই পারেন জাতিকে ব্যতিক্রম কিছু উপহার দিতে। আমরা একটি সফল সম্মেলনের প্রত্যাশা করি।’ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের সফলতা কামনা করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবও। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা হলো— দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে তারা ভূমিকা পালন করবে।’ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সফলতা কামনা করি। একই সঙ্গে নতুন নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা থাকবে অসাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদমুক্ত এবং আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালনের।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর