বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

টেনশনে সাবেক ছাত্রনেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছাত্রলীগের সাবেক শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি খুবই ক্ষীণ। বলা যায় তারা উপেক্ষিত। আগেকার সম্মেলন- গুলোর প্রাক্কালে যেমন, তেমন এবারও তারা দোলাচলে রয়েছেন— ‘পদ কি পাব, নাকি পাব না?’ টেনশন চলছেই। টেনশনেই প্রহর কাটাচ্ছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। শুধু ঠাঁই পাওয়া না পাওয়াই নয়, যারা সর্বশেষ কমিটিতে ছিলেন, তাদের মধ্যেও চলছে নানা উদ্বেগ। ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মধ্যে যারা রাজনীতির কঠিন পথ অতিক্রম               করে নিজেদের ধরে রেখেছিলেন তাদের সিংহভাগ কোথাও ঠাঁই পাননি। অথচ বিএনপির রাজনীতিতে এদের সমবয়সীরা অনেকেই এমপি, মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছেন। বয়স কত হলে বা আর কত পথ হাঁটলে দলীয় মর্যাদার আসনটি পাবেন, তারা ভেবে কিনারা পান না। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যারা ছাত্রলীগের সভাপতি, সম্পাদক ও আহ্বায়ক ছিলেন, তাদের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাঁচজন, দুজন বিএনপিতে, দুজন অন্য দলে। বাকিরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আছেন বটে, তবে ভুগছেন পরিচয় সংকটে। একদা সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এ রকম ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু ওবায়দুল কাদেরই প্রেসিডিয়ামে ঠাঁই পেয়েছেন। জাহাঙ্গীর কবির নানক হয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, অসীম কুমার উকিল উপ-প্রচার সম্পাদক, আবদুর রহমান ও এনামুল হক শামীম সদস্যরূপে ‘টিকে’ আছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ছাত্রলীগের অনেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যারা আদর্শনিষ্ঠা ও সততার জন্য স্বনামখ্যাত। দল এদের যত্ন করেনি বলে হতাশায় ভুগতে ভুগতে তারা তলিয়ে যাচ্ছেন। নব্বইয়ের ছাত্র আন্দোলনে যারা নাম করেছিলেন, আওয়ামী লীগে এসে তারা যেন ‘আলোহীন’ হয়ে পড়লেন। ওই আন্দোলনের ছাত্রদলের নেতারা বিএনপিতে গিয়ে হয়ে গেলেন ‘রাজা’। জাসদ ছাত্রলীগের সেই সময়ের নেতা শফি আহমেদ এখন আওয়ামী লীগে আছেন, ঔজ্জ্বল্য দেখা যায় না। তার অনুরাগীরা বলেন, শফি যদি জাসদেই পড়ে থাকতেন তাহলে এতদিনে হয়তো এমপি হয়ে যেতেন। জানা যায়, মেধা, সৃজনশীলতা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় সমৃদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ জয় করে কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হয়ে আছেন। কেউ কেউ মনে করেন, এদের এভাবে ‘ওএসডি’ করে ফেলে রাখার চেয়ে দলের নানা স্তরে কাজে লাগালে রক্ত সঞ্চালন ঘটত।

উপেক্ষা-বঞ্চনা : ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমেদ দীর্ঘদিন প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন, এখন তিনি দলের উপদেষ্টা। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী; তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে নেই। সিদ্দিকীর কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাজাহান সিরাজ, পরে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ইসমত কাদির গামাকে করা হয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। সেই ইসমত কাদির গামারও স্থান হয়নি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। ১৯৭৭-৮১ সালের সাধারণ সম্পাদক বাহালুল মজনুন চুন্নুও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। ১৯৮১-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। পরে তাকে আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক করা হয়। কিন্তু এখন দলে তার কোনো পদ-পদবি নেই। তবে এবার তাকে জাতীয় সম্মেলন সফল করার জন্য গঠিত একটি উপকমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ডা. মোস্তফা জালালের সময় সাধারণ সম্পাদক আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও এখন কেন্দ্রীয় পদে নেই। অবশ্য তিনি দশম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের টিকিটে পটুয়াখালী থেকে এমপি হয়েছেন। ১৯৮৩-৮৫ সাল পর্যন্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আবদুল মান্নান ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। তারা দুজনই দশম জাতীয় সংসদের এমপি। জাহাঙ্গীর কবির নানক এখন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আবদুল মান্নানকে কোনো পদে রাখা হয়নি। মান্নান একদা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৬-৮৮ সালে সভাপতি ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তাকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছিল। কিন্তু ‘সংস্কারবাদী’ বিতর্কের কারণে বাদ পড়েছেন, এখন অনেকটাই নিভৃতে রয়েছেন তিনি। সুলতান মনসুরের সময় সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান দলের কেন্দ্রীয় সদস্য মাত্র, তিনি ফরিদপুর থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব দল ত্যাগ করে বিএনপিতে চলে যান, তখন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয় শাহে আলমকে। শাহে আলম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহ-সম্পাদক। হাবিবের কমিটির সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের দলে অবস্থান উপ-প্রচার সম্পাদক। অথচ তার কর্মী ড. হাছান মাহমুদ দলের প্রচার সম্পাদক। ১৯৯২-৯৪ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী। তিনি এখন রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে। সাধারণ সম্পাদক ইকবালু রহীম সংসদের সদস্য ও হুইপ হয়েছেন। ১৯৯৪-৯৮ সালে দায়িত্ব পালনকারী সভাপতি এনামুল হক শামীম দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাত্র, অথচ তার হাতে তৈরি নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। শামিমের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নাও এখন কোথাও নেই। ১৯৯৮-২০০২ সালের সভাপতি বাহাদুর বেপারী ও সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই। ২০০২-২০০৬ সালের সভাপতি লিয়াকত শিকদারের দলীয় অবস্থান নেই। সারা দেশে মাঠের জনপ্রিয় সাবেক এই ছাত্রনেতা উপকমিটির সহ-সম্পাদক মাত্র। তার কমিটির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নেই। ২০০৬-১১ সালের সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন ছাত্র রাজনীতি থেকে সাড়ে পাঁচ বছর আগে বিদায় নিলেও এখনো কোথাও স্থান হয়নি। সদ্য বিদায়ী এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সিদ্দিকী নাজমুল আলম এখন পরিচয়হীন। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত নবীনরা পদ-পদবির জন্য লবিং-তদবির শুরু করলেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন সিনিয়ররা। তবে দলীয় কর্মসূচিতে হাজির হচ্ছেন নিয়মিত। তাদের একটাই টেনশন কাজ করছে, এবার কি ভাগ্য শিকে ছাড়বে! মিলবে কি সম্মানজনক পদ? স্নায়ুচাপ বাড়ছে তাদের। সভাপতি, সম্পাদক না হলেও বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে মাহবুবুল হক শাকিল, সাইফুজ্জামান শিখর, মারুফা আক্তার পপি, অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, গোলাম সরোয়ার কবির, ইকবাল হোসেন অপু, আকতার হোসেন, রুবিনা আক্তার মিরাসহ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবারের সম্মেলনে আশায় বুক বেঁধে আছেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়ার জন্য।

সর্বশেষ খবর