সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নতুন যুগে আওয়ামী লীগ

শেখ হাসিনা সভানেত্রী কাদের সম্পাদক নির্বাচিত

রফিকুল ইসলাম রনি

নতুন যুগে আওয়ামী লীগ

রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে গতকাল পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম —বাংলাদেশ প্রতিদিন

আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে কাউন্সিলরদের বিপুল সমর্থনে টানা অষ্টমবারের মতো দলের সভাপতি হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আর আওয়ামী লীগের ইতিহাসে এই প্রথম দলীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও  বর্তমান সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ ছাড়া ঘোষিত কমিটির প্রেসিডিয়ামে স্থান পেয়েছেন নতুন সাত মুখ। এর মাধ্যমে এক নতুন যুগে পা দিল আওয়ামী লীগ। প্রধান দুই পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় দলের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল  কাদেরের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় মিলনায়তনে উপস্থিত কাউন্সিলররা বিপুল উল্লাস আর করতালির মাধ্যমে তাদের অভিনন্দন জানান। গতকাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সকাল সাড়ে ৯টায় শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। দুপুরে দেড় ঘণ্টা বিরতি দিয়ে ৩টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ৪১টি জেলার কাউন্সিলররা বক্তব্য রাখেন। এরপর দলের ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব কাউন্সিলে পাস হয়। সমাপনী বক্তব্যে শেখ হাসিনা আবারও সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি চাইলে সব কাউন্সিলর দাঁড়িয়ে ‘নো নো’ বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত প্রবল দাবির মুখে তিনি হার মানতে বাধ্য হন। বিদায়ী বক্তব্য শেষে বিকাল ৫টা নাগাদ আগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তিনি। পরে নির্বাচন কমিশনের হাতে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে মঞ্চ ছেড়ে তিনি কাউন্সিলরদের আসনে এসে বসেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, অন্য দুই নির্বাচন কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও সাবেক সচিব রাশিদুল হাসান নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রথমে সভাপতি পদে নির্বাচন দেন। এ পদে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সমর্থন করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার পর পর তিনবার এ পদে আর কোনো প্রস্তাব আছে কিনা জানতে চান। কাউন্সিলররা ‘কেউ নেই, কেউ নেই’ বলে সমস্বরে বলতে থাকেন।  সভাপতি পদে অন্য কোনো প্রস্তাব না থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতিক্রমে এ পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এ সময় তুমুল করতালি আর স্লোগানে পুরো মিলনায়তন উল্লাসে মুখরিত হয়ে ওঠে। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সমর্থন করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। এ পদে অন্য কোনো প্রস্তাব না আসায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে ওবায়দুল কাদেরকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। তখন তুমুল করতালির মাধ্যমে তাকেও অভিনন্দন জানান কাউন্সিলররা। ৬৫ বছর বয়সী ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হয়ে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার পা ছুঁয়ে সালাম করেন। এরপর জড়িয়ে ধরেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। আশরাফের সঙ্গে আলিঙ্গন শেষে প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহারা খাতুনকেও পা ছুঁয়ে সালাম করেন তিনি। নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচন কমিশন মঞ্চ ত্যাগ করার পর নতুন সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঞ্চে ওঠেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী সভাপতিমণ্ডলীর ১৯টি পদের মধ্যে ১৬টি এবং ৪টি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং কোষাধ্যক্ষ পদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, আশরাফকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ও আমার ছোট ভাইয়ের মতো। শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে সে সংগঠন ও দেশকে ভালোবেসেছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করেছে। এ জন্য ধন্যবাদ জানাই। আশা করি সংগঠন আরও শক্তিশালী হবে। নতুন সাধারণ সম্পাদক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রনেতা থেকে সে এ পর্যন্ত উঠে এসেছে। সে সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় দল আরও শক্তিশালী হবে বলে আমি মনে করি।

সাত নতুন মুখ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে : আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির আকার কিছুটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে এতে যোগ হয়েছে কিছু নতুন মুখ। আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে নতুন গঠনতন্ত্র ও কমিটি অনুমোদন হয়। ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আকার করা হয়েছে ৮১। এর মধ্যে বেড়েছে প্রেসিডিয়ামে ৪, যুগ্ম ১, সাংগঠনিকে ১ ও সদস্যের ২টি পদ। দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামে যোগ হয়েছে সাত নতুন মুখ। আওয়ামী লীগে নতুন প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন সদ্যবিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার পর দুঃসময়ে দলের হাল ধরতে এগিয়ে আসা আশরাফ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফের ওপর ভরসা রেখে তাকে মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে এনেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রেসিডিয়াম পদ থেকে বাদ পড়েছেন নূহ-উল আলম লেনিন ও সতীশ চন্দ্র রায়। গতকাল বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে টানা অষ্টমবারের মতো সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেসিডিয়ামসহ চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করেন। নতুন আরও ছয় প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেন—বিগত কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, দলের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, বিগত কমিটির দফতর সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র ও যশোরের পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য প্রেসিডিয়ামে স্থান পেয়েছেন। পুরনোদের মধ্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফরউল্লাহ, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। পুরনো যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান। অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক গত কমিটিতে ক্রমিক নম্বরে তিন নম্বরে থাকলেও এবার দ্বিতীয় স্থানে। প্রথমে মাহবুব-উল আলম হানিফ, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ডা. দীপু মনি। আর চার নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেন আবদুর রহমান। কোষাধ্যক্ষ পদে আগের এইচ এন আশিকুর রহমানই বহাল আছেন। কমিটির ১৯ সদস্যের প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে ১৬ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদাধিকারবলে প্রেসিডিয়াম সদস্য। কমিটি ঘোষণার সময় দলীয় সভাপতি জানান, তিনি সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবেন বাকি ৬০ পদ।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে পরিবর্তন : আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। গতকাল সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র পরিবর্তনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।

পরিবর্তিত গঠনতন্ত্রে যা আছে : এবারের গঠনতন্ত্রে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অবয়ব বাড়ানো হয়েছে। আগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ছিল ৭৩ সদস্যের। এবার আটজন বাড়িয়ে ৮১ সদস্য বিশিষ্ট করা হয়েছে। আগের কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৫। নতুন কমিটিতে থাকছে ১৯ সদস্য। অর্থাৎ সভাপতিমণ্ডলীতে চারটি পদ বাড়ানো হয়েছে। আগের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ ছিল তিনটি। এবার এ পদে একটি বাড়িয়ে চারটি করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক পদ একটি বাড়িয়ে আটটি করা হয়েছে। আগের কমিটিতে কেন্দ্রীয় সদস্য ছিল ২৬ জন। নতুন কমিটিতে দুজন বাড়িয়ে ২৮ জন করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা কমিটি ৭৫, উপজেলা ৭১, ইউনিয়ন ৬৯ ও ওয়ার্ড কমিটি ৫৫ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও বোর্ড গঠন, যুদ্ধাপরাধীর সন্তানেরা আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবেন নাসহ বেশ কিছু বিধান সংযোজন করা হয়েছে গঠনতন্ত্রে। গঠনতন্ত্রে চাঁদার হার কাউন্সিলরদের ১০০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা, প্রাথমিক সদস্যদের ১০ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এমপিদের চাঁদা ৫০০ টাকার স্থলে হবে ২০০০ টাকা চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে।

পরিবর্তিত ঘোষণাপত্রে যা আছে : ঘোষণাপত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না রাখা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, ব্লু ইকোনমি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলার আয় বৃদ্ধি ও এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ (৮.০ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বেসরকারি ও সরকারি খাতে শিল্পায়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে দলের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও অঙ্গীকার আছে ঘোষণাপত্রে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর