বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কমিটি নিয়ে যত আলোচনা

রফিকুল ইসলাম রনি

কমিটি নিয়ে যত আলোচনা

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকীয় পদে তেমন পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন পদ পুনর্বণ্টন করা হয়েছে। সম্পাদকমণ্ডলীতে নতুন যুক্ত হয়েছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তবে এখনো ঘোষণার বাকি রয়েছে সাতটি সম্পাদকীয় পদ। গতকাল দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২২টি সম্পাদকীয় পদে নেতাদের নাম ঘোষণা করেন। এতে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদের যেমন মূল্যায়ন করা হয়েছে, তেমন মূলধারার রাজনীতিতে অনেকটা অপরিচিতরাও এসেছেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। আবার দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত, নিষ্ক্রিয় ও সাংগঠনিক অদক্ষতা, কমিটি গঠন ও গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময়ে নানা অভিযোগে অভিযুক্তদের নতুন কমিটিতে রাখায় দলের ভিতরে-বাইরে চলছে নানামুখী আলোচনা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ অফিস থেকে জানানো হয়, দুপুর ১২টায় সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দলের বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে ২২ জনের নাম ঘোষণা করেন। এর আগে রবিবার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে কাউন্সিল অধিবেশনে সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা প্রেসিডিয়ামের ১৪ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের চারজন ও কোষাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করেন। এখনো প্রেসিডিয়ামের তিনটি, সম্পাদকমণ্ডলীর পাঁচটি, উপসম্পাদকের দুটি এবং কার্যনির্বাহী সংসদের ২৮টি পদ খালি আছে।

প্রথম দিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জাহাঙ্গীর কবির নানকের নাম ছিল নামের ক্রমানুসারে দ্বিতীয়। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে নানকের নাম আগের কমিটির ক্রমানুযায়ী অর্থাৎ তিন নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই ঘোষণা করা হয়। চতুর্থ নম্বরে নতুন যুক্ত হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান। সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, বি এম মোজাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আগের দুই কমিটিতেও একই পদে ছিলেন। কেবল বীর বাহাদুরের স্থলে এসেছেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি রাজনীতিতে নতুন। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কোনো পদপদবিতে ছিলেন না তিনি কখনই। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নতুন এসেছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জাকসুর সাবেক ভিপি এ কে এম এনামুল হক শামীম। তিনি আগের কমিটিতে সদস্য ছিলেন। একইভাবে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্থলে অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন রংপুর-৪ আসনের এমপি টিপু মুন্সী। পরিকল্পনামন্ত্রী কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একজনের একাধিক পদে থাকার সুযোগ নেই। সে কারণে তাকে সম্পাদকমণ্ডলীতে রাখা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় সদস্য পদে থাকতে গঠনতন্ত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। আইনবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মতিন খসরু আগের পদেই রয়েছেন। তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আফজাল হোসেন স্বপদেই বহাল আছেন। সদস্য থেকে পদোন্নতি পেয়ে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুজিত রায় নন্দী। এ পদে ছিলেন ফরিদুন্নাহার লাইলী। আর দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ আবদুল্লাহ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরাও আছেন আগের পদে। উপদফতর সম্পাদক থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদকে পদোন্নতি পেয়েছেন মৃণালকান্তি দাস। এ পদে আগে ছিলেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম।

শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন শামসুন নাহার চাঁপা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হল ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের হাউস টিউটর ছিলেন বলেও জানা যায়। তিনি রাজনীতিতে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন। শামসুন নাহার চাঁপা প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাকের সম্পর্কের বোন। রাজনীতিতে ও পদপদবিতে আসতে পারেন এমন আলোচনায় না থাকলেও তিনি এই পদ পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। আগে এ পদে থাকা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নতুন কমিটির প্রেসিডিয়ামের সদস্য হয়েছেন। শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক আবদুস ছাত্তার, শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজও আছেন আগের পদেই। উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক থেকে এবার সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। তিনি আগের কমিটিতে উপপ্রচার সম্পাদক ছিলেন। পদটি এখনো ফাঁকা রয়েছে। এ পদে আগে ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক পদে নতুন মুখ হিসেবে এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রোকেয়া সুলতানা। তিনি দলের সরাসরি কোনো পদে ছিলেন না। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এ পদে আগে ছিলেন ডা. বদিউজ্জামান ভুইয়া ডাবলু।

একসময়ের কমিউনিস্ট নেতা আবদুল মান্নান খান দফতর সম্পাদক থেকে এবার প্রেসিডিয়ামে স্থান পেয়েছেন। তিনি ২০০৯ সালের সরকার গঠনের পর গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ‘নির্বাচনকালীন সর্বদলীয়’ সরকার গঠনের সময় ৩০ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে তিনিও বাদ পড়েন। একসময়ের প্রতাপশালী প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এরপর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে কয়েকবার হাজিরা দিতে হয় তাকে। প্রেসিডিয়ামের আরেক সদস্য পীযূষ ভট্টাচার্য যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি এমপি হন। রাজনীতিতে জাতীয়ভাবে পরিচিত নন তিনি। প্রেসিডিয়ামে স্থান পাওয়ায় তাকে নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। তার আপন ভাই স্বপন ভট্টাচার্য যশোর-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। আগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সতীশচন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ছিল। তার বয়সও হয়েছে যথেষ্ট। এদিকে প্রেসিডিয়াম থেকে বাদ পড়া নূহ-উল-আলম লেনিনকে নিয়ে দলের ভিতরে সমালোচনা ছিল তিনি গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্য কুশীলব হিসেবে কাজ করেছেন।

যাদের কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে তাদের মনোনয়ন নয় : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দলে অনেক পরিবর্তন আসছে। যারা জনগণের সঙ্গে আচরণ খারাপ করবে, যাদের অপকর্মের কারণে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, আগামী নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন।

দলের নতুন কর্মপরিধি বাড়ানোর বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, আপাতত লক্ষ্য পরবর্তী নির্বাচন। ২০২১ সালের মধ্যে উন্নয়ন-অর্জনের ধারাকে অব্যাহত রাখা এবং এই মুহূর্তে আমাদের প্রকাশ্যে কোনো শত্রুতা করার মতো প্রতিপক্ষ খুবই দুর্বল। এখনো আমরা মনে করি, আমাদের গোপন শত্রু হলো উগ্রবাদ। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তা প্রতিহত করব।

 তুলনামূলক কম পরিচিত অনেক নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে চমকের কিছু নেই। প্রেসিডিয়ামে যারা নতুন এসেছেন, তাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ঢাকার পাদ-প্রদীপের আলোয় তারা নেই। কিন্তু নিজের এলাকা তৃণমূলে তারা অত্যন্ত অভিজ্ঞ, পোড় খাওয়া এবং আমাদের নেত্রী তৃণমূল থেকে অনেককে টেনে এনেছেন। যেমন চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দিনের ছেলে নওফেলকে আনা হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় তিনি পরিচিত নন, চট্টগ্রামে তার পরিচিতি আছে। সেখানে তিনি কাজ করতেন।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের এবারের কমিটিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, কমিটিতে আরও নতুন মুখ আসবে। নতুন রক্ত সঞ্চালনও এখানে থাকবে। এবারের কমিটিতে বামদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের বিষয়ে কাদের বলেন, এখানে বাম-ডানের বিষয় নয়। মতিয়া চৌধুরী ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন প্রায় ৩৬ বছর। এখনো তাকে আমরা বাম বলব? এত দিন পরে তাদের বাম-ডানে চিহ্নিত করা সুবিচার হবে না।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ড. আবদুর রাজ্জাক, মাহবুব- উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আবদুস সাত্তার, সুজিত রায় নন্দী, বদিউজ্জামান ভুইয়া ডাবলু প্রমুখ।

 

হতাশা রাজশাহী খুলনা বরিশালে

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর