বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

তিনি মুখ খুললেই নতুন গল্পের সন্ধান পেতাম

সমরেশ মজুমদার

তিনি মুখ খুললেই নতুন গল্পের সন্ধান পেতাম

একটা সময় ছিল যার প্রতিটি বিকালে আনন্দবাজারের একদা কর্তা সন্তোষকুমার ঘোষের ঘরে আড্ডা মারতে যেতাম। সেই তরুণ বয়স থেকে আমি সন্তোষকুমারের ছোট গল্পের খুব ভক্ত ছিলাম। তার ‘কিনু গোয়ালার গলি’ উপন্যাস অবশ্যই খারাপ লাগেনি, কিন্তু মনে হলো তিনি এবং তার দুই বন্ধু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও নরেন্দ্রনাথ মিত্র বাংলা ছোট গল্পকে বিশ্বমানে নিয়ে গিয়েছেন। আমি যখন কলকাতায় পড়তে এলাম তখন সন্তোষকুমার সাহিত্যিক হিসেবে যতটা সক্রিয়, তার অনেক বেশি সম্পাদক-সাংবাদিক হিসেবে। ধীরে ধীরে জানলাম তিনি অত্যন্ত দাম্ভিক, মুখের ওপর যা সত্য ভাবেন তা-ই বলেন। যে জগতে তিনি বিচরণ করেন সেখানে পৌঁছনোর কথা আমার নয়, তাই আগ্রহ তৈরি হয়নি। বোধহয়, ’৭৫ সালের বড়দিনের পরের দিন বাড়িতে ফোন এলো। সরাসরি বললেন, ‘আমি সন্তোষকুমার ঘোষ, আপনি সমরেশ মজুমদার?’

বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘ইয়ে মানে...।’ ‘কোনো মানে-টানে নেই। আমি কখনো ‘দৌড়’ লিখতে পারতাম না।’ বলে লাইন কেটে দিয়েছিলেন।

তার পরের দিন দুই পাতার চিঠি পেলাম। কোথায় তার ভালো লেগেছে, কেন ভালো লেগেছে সমস্ত বলার পর আমার ত্রুটিগুলোর কথা বলেছেন। শেষে মন্তব্য করেছেন, কোনো ক্রিকেট খেলোয়াড় দু-তিনবার ক্যাচ দিয়েও রক্ষা পেয়ে শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি করে ফেললে দর্শক হাততালি দেয়। রেকর্ড-বুক সেঞ্চুরির কথাই লিখে রাখে। ভবিষ্যতের মানুষ ক্যাচ মিস করার কথা মনে রাখবে না। কিন্তু সতর্ক থেক। তখন আনন্দবাজারের বাড়ির দোতলায় যেতাম। যেখানে ‘দেশ’ পত্রিকার ঘরে বিমল কর বসতেন। পাশেই রবিবাসরীয়র ঘরে রমাপদ চৌধুরী। কিন্তু প্রথম দিকে তার কাছে আমল পাইনি। বিমলদার কাছে জানতে পারলাম, সন্তোষকুমার ঘোষ খুব মুডি মানুষ। কখন কী আচরণ করবেন তা আগে ঠাওর করা যাবে না। মুখের ওপর সত্যি কথা বলতে দ্বিধা করেন না। তিনি বসতেন তিনতলায়। কয়েক দিন ধরে এসব শোনার পর সাহসী হলাম। তিনতলায় উঠে ওঁর ঘরের বন্ধ দরজায় শব্দ করলাম। কোনো সাড়া নেই। শেষ পর্যন্ত দরজা ঠেলতেই ওটা খুলে গেল। লম্বা ঘরের শেষ প্রান্তে টেবিলের ওপাশে সন্তোষকুমার, হাতে বই। বিরক্ত চোখে তাকিয়েই প্রশ্ন, ‘কী ব্যাপার?’

আমি থতমত, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।’

‘দেখা করতে? না দেখা দিতে? কোনো শিষ্টাচার নেই। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার বালাই নেই?’

এ সময় একটি সদ্যযুবক ঘরে ঢুকতেই সন্তোষকুমার তার ওপর খড়গহস্ত হলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে? দরজা খুলে হুটহাট উটকো লোক ঢুকে পড়ছে? তোমার তো দেখছি কিছুই খেয়াল থাকছে না। বের কর একে।’

যুবক আমাকে ততক্ষণে বোধহয় চিনে ফেলেছেন। বললেন, ‘আমি টয়লেটে গিয়েছিলাম, ইনি আসবেন জানলে অপেক্ষা করতাম। বেশ কয়েকবার আপনি ওর প্রশংসা করেছেন।’

আমি? চিনলাম না জানলাম না, কী নাম?

‘সমরেশ মজুমদার।’ জবাব দিলাম।

‘অ। এমন কিছু হাতিঘোড়া লেখেনি যে চিনে রাখতে হবে। জলপাইগুড়ির আদিবাসী তো, সহবত শেখেনি। কোথায় বাড়ি? কোন চা-বাগানে?’

‘গয়েরকাটায়।’

‘ধুপগুড়ি এবং বীরপাড়ার মাঝখানে। তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘বকের মতো দাঁড়িয়ে কেন? সিট ডাউন।’

সেই প্রথম। তারপর দিনের পর দিন তার কাছে গিয়েছি আর দু-হাতে কুড়িয়ে নিয়েছি।

তিনি মুখ খুললেই আমি নতুন গল্পের সন্ধান পেয়ে যেতাম। ওই ঘরের অন্য প্রান্তে ছোট্ট কেবিনে বসত সুমন, প্রথম দিনের সাক্ষী। সন্তোষকুমারের সাহায্যকারীর ভূমিকায় ছিল। পরে প্রায় শীর্ষে উঠে গিয়েছিল কিন্তু আমার মনে হয় লেখালেখিটা ওর ওই ঘরেই হয়েছিল।

সন্তোষকুমারের লেখা ‘মোমের পুতুল’ গল্পটি পড়েছিলাম ফার্স্ট ইয়ারে। এত ভালো গল্প যে ভুলতে পারিনি। কিন্তু ওই গল্প বা ‘কিনু গোয়ালার গলি’ উপন্যাসের কথা বললে উনি ক্ষুব্ধ হতেন। হাত নেড়ে বলতেন, ‘বলবে না। কবে কোন যুগে লিখেছি আর আজও লোকে ওগুলোর নাম যখন বলে তখন বুঝিয়ে দেয় এর মধ্যে আর কিছু লিখিনি।’

সন্তোষকুমারের প্রধান সমস্যা ছিল আর এক সন্তোষকুমার যিনি তার লেখকসত্তাকে জবরদখল করে রাখতেন। হঠাৎ তার লেখার স্টাইল বদলে গেল। অকারণ জটিলতা আসায় তার লেখায় এমন কুয়াশা তৈরি হতো যে পাঠক তা ভেদ করে কাহিনীতে পৌঁছতে পারত না। বৈদগ্ধ্যের চূড়ান্ত নিদর্শন তার শেষ পর্বের লেখাগুলো তাই সাধারণ পাঠকদের জন্য নয়।

একটু একটু করে আমি ওর ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। আনন্দবাজার থেকে বেরিয়ে মিশন রো-তে যেতেন তিনি। সেখানকার এক পানশালায় তার আলাদা খাতির ছিল। সেখানে বসে যেসব কথা বলে যেতেন, সাহিত্য এবং জীবন নিয়ে দক্ষ বিশ্লেষণ করতেন, তা আমার কাছে নতুন বলে মনে হতো। অনার্স বা এমএ ক্লাসের অধ্যাপকরা যেখানে শেষ করেছেন উনি সেখান থেকে শুরু করেছেন। একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, শয়তান আর মরণের সম্পর্ক কী বল তো? হেসে বলেছিলাম, ‘স্বামী-স্ত্রী।’ সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে চড় মেরে বলেছিলেন, ‘বেড়ে বলেছে। একটা লাইন তৈরি কর।’ এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ওর লেখার স্টাইলে বললাম, ‘এমনও তো বলা যেতে পারে, একাকিত্ব বোঝা হয়ে গেলে মরণ ছুটে যায় শয়তানের কাছে। গিয়ে বলে, তোমার পাশে থাকি? শয়তান বলে, ‘সর্বনাশ! তা হলে তুমি যে গর্ভবতী হবে।’

সন্তোষকুমার আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুমি কি নিজেকে খুন করতে চাও। আমার মতো করে লিখলে সব পাঠক তোমাকে ত্যাগ করবে, জানো না?

না, একটি মৃত যা বলতে পারে, লিখতে পারে, কোনো জীবিতের উচিত নয় তা অনুকরণ করা।’

সেই রাতে বাড়ি ফিরে, কোনো দিন যা করি না, সারা রাত জেগে একটি গল্প লিখলাম। গল্পটির নাম ভ্রমণবৃত্তান্ত। পরদিন ‘দেশ’ পত্রিকায় বিমল কর-কে দিয়ে এলাম। তখন ‘দেশ’ ছিল সাপ্তাহিক। পরের সপ্তাহেই সেটা বেরিয়ে গেল। গল্পের শুরুটা এরকম ছিল—

সেই যে, কে যেন বলেছিলেন, ‘অনেক হলো, এবার মরণের পাশে শুতে চাই নিশ্চিন্তে!’

কেউ জবাব দিয়েছিলেন, ‘এখনই! তা হলে যে মরণও গর্ভবতী হবে।’

চমকে উঠেছিলেন তিনি। ভোকাট্টা সুতোকে গুটিয়ে নেওয়ার মতো মুখ করে নিজের মনেই বলেছিলেন, ‘হায়! তা হলে যে সন্তান জন্ম নেবে তার নাম শয়তান।’

সর্বশেষ খবর