মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড

জুলকার নাইন

খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড

খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য রেকর্ড ছুঁয়েছে। ইতিমধ্যেই চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ রোপা আমন উৎপাদনের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০১ শতাংশ বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। শুধু ধান নয় প্রায় প্রতিটি খাদ্যশস্য উৎপাদনেই রেকর্ড করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ফল ও মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হার বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। প্রতিদিনই বাড়ছে সবজির উৎপাদন। কৃষিবিদরা বলছেন, কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এখন রেকর্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বিশ্বে পথিকৃৎ বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। গত কয়েক বছরে দেশের মানুষকে খাওয়ানোর জন্য বাংলাদেশ একটি চালও আমদানি করেনি। এখন সুযোগ তৈরি হয়েছে খাদ্য রপ্তানি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মতে, কৃষিতে বিজ্ঞানভিত্তিক নানা পদক্ষেপের কারণেই খাদ্য উৎপাদনে আজ আমরা নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি। খাদ্য সংকট এখন আর নেই বরং আমরা কিছু হলেও এখন অন্যকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জানা যায়, স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। এর পরের ৪২ বছরে এখানে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ, আর আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিন গুণ বেশি; ভুট্টাসহ এর পরিমাণ এখন পাঁচ কোটি মেট্রিক টনের বেশি। নেই খাদ্য ঘাটতিও। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারের হালনাগাদ তথ্যানুসারে দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ ৯ দশমিক ৩৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ৬ দশমিক ৪৫ লাখ মেট্রিক টন এবং গম ২ দশমিক ৯২ লাখ মেট্রিক টন। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। জাতীয় পরিসংখ্যান বলছে, কৃষি খাতে জিডিপির অবদান ২১ শতাংশ, কৃষি শ্রমে ৪৮ শতাংশ আর কৃষির সাব-সেক্টরসহ এ অবদান ৫৬ শতাংশ। সূত্র মতে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশের চাল নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে সাত দেশ। মিসর, মালদ্বীপ, নাইজেরিয়া, মরক্কো, সাউথ আফ্রিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ। রপ্তানির বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে খাদ্যশস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গুণগতমানের পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগ্রহী ক্রেতা  দেশের পাশাপাশি নতুন দেশও খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহী দেশগুলোয় চালের নমুনা পাঠানোর চিন্তা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দরদামে পোষালে বিশ্ববাজারে ২ লাখ টন মোটা চাল রপ্তানি করার একটি পরিকল্পনাও আছে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশের ছয়টি কৃষিপণ্য দুই বছর আগেই রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়েছে। চাল, গম, ভুট্টা, আলু, পাট এবং পিয়াজ মিলিয়ে উৎপাদন তখনই ৫ কোটি টন ছাড়িয়ে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ ছয়টি প্রধান ফসলের মোট উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৯৪ লাখ ৬৯ হাজার ৭৩২ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রাথমিক হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬ লাখ ৫০ হাজার ২১৫ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ছয়টি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ১১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৩ টন। এর মধ্যে চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬৭ টন, গম ৪৪ হাজার ৯২৮ টন, পাট ১১ হাজার ৭৬১ টন, ভুট্টা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪২৮ টন, পিয়াজ ৩ লাখ ১৭ হাজার ২৩৮ টন এবং আলুর উৎপাদন বেড়েছে ৩ লাখ ৪ হাজার ২৬১ টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। গত এক যুগে রীতিমতো ঘটে গেছে সবজি বিপ্লব। গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও)। বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। এফএওর বৈশ্বিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদন বলছে, ফল উৎপাদনের দিক থেকে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল বিশ্বের পর্যায়ক্রমে শীর্ষস্থানে রয়েছে। আর মোট ফল উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে ২৮তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে দুই বছর ধরে বাংলাদেশের ফলের উৎপাদন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ থেকে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। এফএওর হিসাবে সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। তবে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসার পর বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের মৎস্য আহরণ কয়েক গুণ বাড়বে বলে এফএও’র ধারণা। অবশ্য মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এখনই।  পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগে সদস্য ড. শামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান সরকার তার মেয়াদকালে দক্ষতার সঙ্গে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করে। এ সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান বিষয় যেমন মোট দেশজ আয়, কর্মসংস্থান, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস, সামাজিক খাতের দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু নিরাপত্তায় অগ্রগতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। সেই ধারাবাহিকতায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কৃষি সরকারে ভর্তুকি, কৃষকদের মাঝে কৃষি যন্ত্রপাতি হস্তান্তর, কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করে তোলাসহ নানা উদ্যোগের ফলই হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কৃষির উন্নয়নে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির কোনো বিকল্প নেই। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন জাত আবিষ্কার খাদ্য উৎপাদনে নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

তবে এটা অনস্বীকার্য যে কৃষি ক্ষেত্রে যেটুকু অর্জন হয়েছে তার সিংহভাগই এসেছে দেশের কৃষক ও কৃষিজীবীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। তাই কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের বিভিন্ন সেবার মান স্বচ্ছ ও আধুনিক হতে হবে। কৃষকের ভাষাতেই প্রযুক্তির সব বিষয় তুলে ধরতে হবে। কৃষক যখন প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার দেখবে তখন তারা নিজেরাই সে সবের ব্যবহার শুরু করবে। তখন খাদ্য উৎপাদনের চিত্র আরও পাল্টে যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর