মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
গুলশান হামলা

চার্জশিট হয়নি, মারজানসহ ১৫ জন লাপাত্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

চার্জশিট হয়নি, মারজানসহ ১৫ জন লাপাত্তা

গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার চার মাস পূর্ণ হলো। গুলশান হামলা মামলার চার্জশিট এখনো দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। গ্রেফতার হননি হামলার সমন্বয়ক নূরুল ইসলাম মারজান। তবে এ হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম নিহত হয়েছেন পুলিশের অভিযানে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগিরই এ মামলার চার্জশিট দাখিল করা হবে।

১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর দুই দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। মামলার তদন্তে প্রথমেই উঠে আসে নব্য জেএমবির নাম। শুরু হয় নিবিড় পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান। সিটিটিসির দাবি, এ ঘটনার বিভিন্ন বিষয়ের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ হামলাকারীসহ এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪-২৫ জনের নাম এসেছে। হামলার বিভিন্ন পর্যায়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন দুজন। তাদের একজন জিম্মি অবস্থায় উদ্ধার হওয়া হাসনাত করিম এবং অন্যজন কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেফতার রাকিবুল হাসান রিগ্যান। রিগ্যান ইতিমধ্যে দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। গুলশান হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ নাগরিক নিহত হন। পরে সেনা কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পাঁচ হামলাকারীসহ ছয়জন। এ হামলার পরপরই জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান নিয়ে নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। অর্থের জোগানদাতা থেকে শুরু করে অস্ত্র সরবরাহকারী, হামলার মাস্টারমাইন্ড, গ্রেনেড সরবরাহকারীদের নাম, হামলাকারীদের কারা প্রশিক্ষণ দিয়েছে, কোথায় কোথায় প্রশিক্ষণ হয়েছে এবং হামলার সমন্বয়কসহ বিস্তারিত রহস্য উদ্ঘাটন করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। গুলশান হামলা মামলার তদন্তের অন্যতম তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, গুলশান হামলার তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত মাস্টারমাইন্ড, অর্থ ও অস্ত্রের জোগানদাতাসহ অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই এ মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে। সূত্র জানায়, তদন্তে গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ডকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এই মাস্টারমাইন্ড হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তামিম কানাডা থেকে দুবাই হয়ে ইতিহাদ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন। এর পরই নব্য জেএমবির অপারেশনাল মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তদন্ত সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তামিম চৌধুরী আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ২৭ আগস্ট গোয়েন্দাতথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক অভিযানে তামিম আহমেদ চৌধুরী দুই সহযোগীসহ নিহত হন। সূত্র জানায়, তারা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আগে অন্য একটি রেস্টুরেন্টে হামলার পরিকল্পনা ছিল হামলাকারীদের। কিন্তু মারজানই প্রথমে হলি আর্টিজান বেকারি আবিষ্কার করেন। কারণ সেখানে প্রবেশ সহজযোগ্য ছিল এবং সন্ধ্যার পর বেশিসংখ্যক বিদেশি নাগরিক সেখানে অবস্থান করতেন। পরে মারজানের পরামর্শ অনুযায়ী তামিম হলি আর্টিজানকে টার্গেট করার নির্দেশনা দেন। মারজানের সমন্বয়ে সহযোগিতা করেন রাজীব গান্ধী নামে আরেক জঙ্গি। মারজানের মতো রাজীবও পলাতক। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সময় তামিম ও মারজান গুলশান এলাকাতেই অবস্থান করেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে এবং গণমাধ্যমে জঙ্গি হামলার বিষয়টি প্রচারিত হওয়ার পর তারা গুলশান থেকে কল্যাণপুরের আস্তানায় চলে যান।

তদন্ত সূত্র জানায়, গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া হামলাকারীদের গাইবান্ধা ও বগুড়ার কয়েকটি স্থানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচজন ঝিনাইদহ, বগুড়া ও ঢাকার শেওড়াপাড়া, কল্যাণপুর এবং সর্বশেষ ভাটারা এলাকায় অবস্থান করে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তাদের অস্ত্র ও গ্রেনেড চার্জের প্রশিক্ষণ দেন রায়হান কবির ওরফে তারেক ও জাহিদুল ইসলাম। তারেক ও জাহিদ অস্ত্র ও গ্রেনেড চালনা বিষয়ে এবং রিগ্যান ধর্মীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন বলে তদন্ত সংস্থা জানতে পেরেছে।

অর্থ ও অস্ত্র আসে বিদেশ থেকে : সূত্র জানায়, গুলশান হামলার অর্থ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই থেকে। তামিমের মাধ্যমে গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা আসে। তামিমের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ পথে আসা এ টাকা গ্রহণ করেন বাশারুজ্জামান ওরফে রাহুল ওরফে চকলেট। তদন্ত সূত্র জানায়, গুলশান হামলায় ব্যবহূত অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহ করেন পুরনো জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সোহেল মাহফুজ। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের দাবি, সোহেল মাহফুজ বর্তমানে নব্য জেএমবির হয়ে কাজ করছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এসব অস্ত্র ও গ্রেনেড আনা হয় বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

গুলশানের জঙ্গি হামলার ঘটনায় মোট ৩২ জিম্মিকে উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে সাক্ষী হিসেবে ১৪ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর মধ্যে সত্য প্রকাশ নামে একজন ভারতীয় নাগরিকও রয়েছেন। এ ছাড়া ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হলি আর্টিজান বেকারির কর্মচারীদের পাশাপাশি জিম্মি থাকা তাহমিদের দুই বান্ধবী তাহানা তাসমিয়া ও ফাইরুজ মালিহাও সাক্ষী হিসেবে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর