মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দ্বৈত শাসনে বাধাগ্রস্ত শূন্যপদে বিচারক নিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বৈত শাসনে বাধাগ্রস্ত শূন্যপদে বিচারক নিয়োগ

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা

অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রমের ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিমকোর্টের হাতে না থাকায় ‘দ্বৈত শাসন’ সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের পুনঃপ্রবর্তন সময়ের দাবি। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বলা হয়েছে, সংবিধানের  এরপর  ১০৯ অনুচ্ছেদে অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদের বিধান বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ। এই অনুচ্ছেদের ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিমকোর্টের পক্ষে এককভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্যপদে সময়মতো বিচারক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিচারকাজে বিঘ্ন ঘটে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায় বলে বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। এ প্রেক্ষাপতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন হওয়া সময়ের দাবি মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিমকোর্টের উপর ন্যস্ত থাকবে।’ ওই বিধানটি পুনঃপ্রবর্তন করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সমুন্নত ও সংহত হবে এবং বিচার বিভাগের সার্বিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হবে। উল্লেখ্য, বর্তমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের কর্মদক্ষতার ওপর একটি দেশের সভ্যতার মানদণ্ড নির্ধারিত হয়। অন্য কথায় বলা যায় যে, কোনো দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শত প্রতিকূলতার মাঝেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। বাণীতে বলা হয়, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার এবং বাঙালি জাতির স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি একটি অনন্য সংবিধান। আমাদের মূল সংবিধানে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের বিষয়টি স্পষ্ট থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পৃথক্করণের জন্য অতীতে আন্তরিকভাবে উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। বরং সামরিক সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিভিন্ন সময় লঙ্ঘিত হয়েছে। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের একটি ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়ে এর যাত্রা শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় দীর্ঘ ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসির জন্য পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মিত হয়নি। ১৭০ জন বিচারককে এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ করতে হচ্ছে। এতে বিচারিক কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহার করা যাচ্ছে না; যা মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নিম্ন আদালতে প্রায় ১ হাজার ৯০০ বিচারকের পদের মধ্যে প্রায় ৪০০ পদ খালি। ১ হাজার ৫০০ বিচারকের মধ্যে প্রেষণ ছাড়া ১ হাজার ৩০০ বিচারক বিচারকার্য পরিচালনা করছেন। ১ হাজার ৩০০ বিচারক দ্বারা ২৭ লক্ষাধিক মামলা পরিচালনা করা অসম্ভব। তা ছাড়া প্রতিদিন নতুন মামলা দায়ের হচ্ছে। সঙ্গত কারণে শূন্য প্রায় ৪০০ পদে দ্রুত বিচারক নিয়োগ করা আবশ্যক।

প্রধান বিচারপতি তার বাণীতে বলেন, একটি দেশের বিচার বিভাগের দক্ষতা ও দ্রুত বিচার বিভাগের ওপর ভিত্তি করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হন। সর্বোপরি দেশে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের ওপর আস্থা না থাকলে সামগ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বৃহৎ আকারে বিনিয়োগের পূর্বে নিশ্চিত হতে চান যে বিনিয়োগকালে কোনো বিরোধ দেখা দিলে কত দ্রুত তার প্রতিকার পাবেন। ফলে সর্বোচ্চ সততা, দক্ষতা, দ্রুততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিচার প্রদানে সক্ষম এরূপ বিচার বিভাগ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তিনি বলেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন বিধায় মামলা নিষ্পত্তির হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিচারকদের মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির পরিমাণের ব্যবধান শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।

সর্বশেষ খবর