বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

লুটেরা দুই দলের বাইরে বামদের ঐক্য চাই

রুহুল আমিন রাসেল

লুটেরা দুই দলের বাইরে বামদের ঐক্য চাই

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি—সিপিবি’র সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে কার্যকর বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির উত্থান ঘটাতে চাই। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে কমিউনিস্ট পার্টি তার প্রচেষ্টা আগামী দিনে আরও জোরদার করবে। বুর্জোয়া শাসকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা চার মূলনীতিকে পরিত্যাগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে হলে, কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থিরাই একমাত্র ভরসা। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসুর প্রথম ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আরও বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি ভূলুণ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে চ্যাম্পিয়ন বা প্রধান ভূমিকা পালন করবে। দেশকে বাঁচাতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারা ফিরিয়ে আনুন এবং সে জন্য কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়াসকে সমর্থন ও সহযোগিতা করুন। সিপিবির একাদশ কংগ্রেসের নতুন ডাক সম্পর্কে দেশের প্রধান এই বামপন্থি দলটির শীর্ষ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ ব্যর্থ। বিএনপি আরও বেশি ব্যর্থ। দুটোই লুটেরা বুর্জোয়া দল। দেশে যদি এমন অবস্থাই থাকে যে—একবার এই বুর্জোয়া দল ক্ষমতায় থাকলে, অন্যটা প্রধান বিরোধী দল হয়ে যায়। আর অন্যটা ক্ষমতায় থাকলে, আগেরটা প্রধান বিরোধী দল হয়ে যায়। এই অবস্থা থাকলে দেশকে লুটেরা বুর্জোয়া শাসন থেকে মুক্ত করা যাবে না। দেশে সব সময়ই বুর্জোয়া শাসন বহাল থাকবে। কিন্তু বুর্জোয়া শাসনের দেউলিয়াপনা আজ প্রমাণিত সত্য। লুটেরা বুর্জোয়া শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে প্রয়োজন বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প। তিনি বলেন, মানুষ বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতারণা ও অপশাসনে আজ অতিষ্ঠ। তারা মুক্তি চায়। এই অসহনীয় পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে বামপন্থিদের। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচাতে এই চ্যালেঞ্জ বিজয়ী হওয়ার বিকল্প নেই। এ জন্য জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তিনি বিএনপির কড়া সমালোচনা করে বলেন, যারা জামায়াতের সঙ্গে মৈত্রী করে, জনগণ তাদের সমর্থন দেবে না। বিএনপির ওপর জনগণের আস্থা নেই। বিএনপি না পারলেও কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সিপিবি সভাপতি সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের সব কমিউনিস্ট একতাবদ্ধ হলে হোন। আসুন বামপন্থিরা এক হই। কারণ বামশক্তির উত্থান ছাড়া বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়। আসুন মুক্তি সংগ্রামের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করি। মনে রাখবেন— ‘এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে’। জনগণের শক্তির বিজয় অনিবার্য। কমিউনিস্ট পার্টি মেহনতি মানুষের পার্টি, শোষিত নিপীড়িত মানুষের পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টি ইনসাফের পার্টি, বিপ্লবের পার্টি। দীর্ঘ ৬৮ বছরের সংগ্রামে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মেহনতি মানুষের সংগ্রামে, মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সুমহান লক্ষ্যে এই পার্টি নিয়োজিত আছে। এ দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোতে লাল পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে আমরা লড়াই করেছি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ এই দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে এই পার্টি রেখেছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরসহ সমাজের শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে আমরা থেকেছি সামনের কাতারে। পার্টির অগণিত কমরেড জীবন দিয়েছেন, লাখো কমরেড মানুষের পাশে থাকতে নিজেদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছেন, জেল-জুলুম নির্যাতন সয়েছেন। এদেশের অন্য কোনো দলকে এত আত্মত্যাগ করতে হয়নি। সিপিবি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এদেশের জল-মাটি গায়ে মেখে আমরা পথ চলেছি। কোনো ধরনের আপস-বিভ্রান্তি ছাড়াই মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতে আমরা যেমন ভূমিকা রেখেছি, তেমনি অস্ত্র হাতে লড়াইও করেছি। এদেশের কৃষক-শ্রমিক-খেতমজুর-ছাত্র-তরুণরা তাদের বহুদিনের লালিত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জনগণের প্রত্যাশা ছিল—স্বাধীন দেশের সর্বত্র প্রতিফলিত হবে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের মূলনীতি। সে প্রত্যাশা আজও পূরণ হয়নি। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের মানুষ বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতারণা ও অপশাসনে আজ অতিষ্ঠ। তারা এই জাঁতাকল থেকে মুক্ত হতে চায়। এই অসহনীয় পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে বামপন্থিদের। আসুন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা বাস্তবায়নের কাজে চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠি। মুক্তিসংগ্রামের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করি।

সিপিবি সভাপতি বলেন, রাজনৈতিক শূন্যতা ও রাষ্ট্রের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে উগ্র জঙ্গিবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা মুক্তচিন্তার বিপরীতে মানুষ হত্যা করে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল উগ্র জঙ্গিবাদী শক্তি একদিকে যেমন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, মুক্তচিন্তার মানুষ, সংস্কৃতিকর্মী, বিদেশি অতিথিদের হত্যা করছে, তেমনি সমাজদেহেও ছড়িয়ে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। সিপিবি বরাবরই এই মৌলবাদী শক্তির বিপরীতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আপসহীন সংগ্রামে লিপ্ত আছে। এ কারণেই ২০০১ সালে সিপিবির পল্টন সমাবেশে বোমা হামলা করা হয়েছে। বছর তিনেক আগে যে উগ্র মৌলবাদী শক্তি ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা থেকে বাদ পড়েনি সিপিবি অফিসও। অন্য কোনো দলের অফিস পোড়ানো হয়নি, পুড়েছে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। আমি বলতে চাই— নিজস্ব শক্তিসামর্থ্য নিয়ে তো বটেই, পাশাপাশি সমাজের সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে পাশে নিয়ে সিপিবি সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। সাবেক এই ছাত্র নেতা মনে করেন, আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক, গরিব কৃষক, খেতমজুরসহ মেহনতি মানুষেরা তাদের শ্রমে-ঘামে এ দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছেন। সুশাসন ও গণতন্ত্রের অভাব সত্ত্বেও মেহনতি মানুষের এই প্রাণপ্রাচুর্যময় কর্মোদ্যম আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখায়। জনগণের এই প্রাণান্ত পরিশ্রমের ফসলকে দেখিয়ে সরকার এখন তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-এর গল্প ফাঁদছে। অথচ উন্নয়নের নাম করে কিছু মেগাপ্রজেক্ট, ফ্লাইওভার হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই সব মেগাপ্রজেক্টে চলছে মেগা লুটপাট। এই তথাকথিত উন্নয়নের ফসল যাচ্ছে কার ঘরে? যার দরকার সেই ৯৯ শতাংশ মানুষের বদলে এ উন্নয়নের ফসল যাচ্ছে, যার বেশি আছে সেই মুষ্টিমেয় ১ শতাংশের ঘরে। যাদের শ্রমে ঘামে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, সম্পদ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তারা প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে না। এ যেন, ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। তার মতে, বাজার অর্থনীতি জন্ম দিয়েছে বাজার রাজনীতির। একদিকে ব্যাপকহারে চলছে বাণিজ্যিকীকরণ, অন্যদিকে চলছে ‘হালুয়া-রুটির রাজনীতি’র দাপট। এ কারণে সমাজে মূল্যবোধের বিপজ্জনক অধোগতি ঘটে চলেছে। হত্যা-খুন-ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়েই চলছে। নারী নির্যাতন বাড়ছে, বাড়ছে নারী ও শিশু হত্যার সংখ্যা। বিচার মিলছে না অপরাধের, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক এক ধরনের মাফিয়াতন্ত্র গড়ে উঠেছে। দলের পাণ্ডারা এক ধরনের অঘোষিত ইনডেমনিটি পেয়ে চলছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত আছে, আদিবাসীদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চলছেই। সত্যিকার অর্থে দেশে চলছে চরম অরাজকতাপূর্ণ এক রুগ্ন পরিস্থিতি। জনগণের সামনে এখন চারটি প্রধান বিপদ উল্লেখ করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, লুটপাটতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতা। বিচ্ছিন্নভাবে এই চার শত্রুকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের একই সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির কোনো স্থান থাকতে পারে না। তরুণ প্রজন্ম বিপুল গণজাগরণ তৈরি করে তা বুঝিয়ে দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর