বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যত কারণে আলোচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় সংসদের কক্সবাজার-৪ (টেকনাফ-উখিয়া) আসনের সরকারদলীয় সদস্য আবদুর রহমান বদি। সভা-সেমিনারে দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বক্তৃতা করেন তিনি, এটি তার প্রকাশ্য জীবন। তার আরও একটি জীবন রয়েছে; যা প্রকাশ্য নয়। দেশের ইয়াবা ব্যবসার সর্বোচ্চ গডফাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অন্ধকার জগতের এই মুকুটহীন সম্রাট। তার ভয়ঙ্কর ছোবলে বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ প্রান্তের সাগর-পাহাড়-বনভূমিঘেরা টেকনাফ এখন বিষে জর্জরিত। সুন্দর এ জনপদটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের অবাধ বিচরণ ভূমি।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাদককারবারিদের সঙ্গেও তিনি গড়ে তোলেন সখ্য। দক্ষিণ এশিয়ার মাদক সাম্রাজ্যে এমপি বদির পরিচয় ‘মেজ ভাই’ নামে। চোরাচালান, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল তার অন্ধকার জগেক সমৃদ্ধ করেছে। এমপি বদি এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে, তার কথামতো কাজ না করায় তিনি নিজেই মারধর করেছেন সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেককেই। মাদক ও চোরাচালান করতে এমপি বদি নজিরবিহীনভাবে ব্যক্তিগত বন্দর ও ঘাট পর্যন্ত গড়ে তোলেন। বদি পরিবার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ইয়াবা ব্যবসা।

উত্থান : অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত অথবা আওয়ামী লীগ; যে আমলেই হোক, যেভাবেই হোক সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন আবদুর রহমান বদি। বিএনপির কাছে মনোনয়নও চেয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়েই পার হয়েছেন বৈতরণী। এরশাদ সরকারের সময় বদির বাবা এজাহার মিয়া ছিলেন টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান। বাবার কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি এই এমপির। এরশাদ সরকারের পতনের পর বদির বাবা যোগ দেন বিএনপিতে। টেকনাফের বাসিন্দারা জানান, বাবার হাত ধরেই টেকনাফ উপজেলা বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন বদি। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিএনপি আমলে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে চোরাচালানে আসা বিভিন্ন পণ্য ব্যবসায় হাত পাকান বদি। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তেই বিএনপির কাছে মনোনয়ন চেয়ে বসেন তিনি। কথিত আছে, অপকর্মের খবর জেনে যাওয়ায় তাকে বিএনপি মনোনয়ন দেয়নি। এরপর রাতারাতি নিজেকে পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বদি। সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ ও ১৯৯৬ সাল ছাড়া পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় কক্সবাজার-৪ আসনে জিততে পারেনি আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে জয়ী হলেন বদি। ব্যস, টেকনাফে শুরু হয় বদির শাসন।

সবার বড় বদি : আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার ছিলেন টেকনাফের এজাহার মিয়া ওরফে এজাহার কোম্পানি। নিরাপত্তা বাহিনীর তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ চোরাকারবারির ১২ স্ত্রীর ২৬ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আবদুর রহমান বদি। জানা যায়, বাবার বিশাল চোরাই ব্যবসায় কিশোর বয়সেই হাতেখড়ি হয় তার। বঙ্গোপসাগর দিয়ে অস্ত্র, মাদকসহ নানা চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের টানেল খ্যাত টেকনাফের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ একসময় চলে আসে বদির হাতে। রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন দলের সঙ্গেও গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক।

মাদকের রাজধানী টেকনাফ : এমপি বদির কারণে টেকনাফ হয়ে ওঠে মাদকের রাজধানী। ইয়াবার জোয়ারে তাই ভাসে গোটা টেকনাফ। এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান ব্যবসাই হয়ে ওঠে ইয়াবা। টেকনাফের রাজনীতি আর অর্থনীতি সব ইয়াবা কেন্দ্র করেই চলে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই, যাদের ইয়াবার ব্যবসায়ে জড়িত করেননি বদি। ইয়াবাকে বদি এতটাই লাভজনক ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, লবণ চাষ, মাছ চাষ, কাঠ ব্যবসাসহ বিভিন্ন বৈধ ব্যবসা ছেড়ে শত শত ব্যবসায়ী ইয়াবায় অর্থ লগ্নি করছেন।

টেকনাফের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বদি পরিবারের হাতে। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এমপির সঙ্গে সব সময় চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চলাফেরা। এমপির ভাই, বন্ধু ও সহযোগীরা বেপরোয়াভাবে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমপির ক্ষমতার জোরেই এটা চলছে, এ কথা সবাই জানে। এখানকার সাধারণ মানুষ এমপি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে অসহায়। মাঝেমধ্যে পুলিশ অভিযান চালায়। ক্রসফায়ার হয়। কিন্তু বড় মাছগুলো সব সময় থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ইয়াবা ব্যবসায়ী বদি ও তার লোকজন সব সময়ই থাকেন প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বার বার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এলেও তারা প্রকাশ্যেই ইয়াবার রাজ্যে দাপিয়ে বেড়ান। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এতটাই প্রভাবশালী যে, জেলা আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে বিষয়টি তোলার কেউ সাহস করেন না। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ইয়াবার চালানও ছাড়িয়ে নিয়ে যান এমপি বদি। ইয়াবা পাচারে কখনো কখনো বদির গাড়িও ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্রমতে, শুধু তাই নয়, এমপি বদি ও তার স্ত্রীর গাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। সর্বশেষ গত বছর আগস্টে কুমিল্লায় বদির উপস্থিতিতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার গাড়ি থেকে বিপুল ইয়াবা উদ্ধার করে। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে তিনি ইয়াবার পুরো চালান নিয়েই ঢাকায় যান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা দেশের ৩১ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ভাই-বেয়াই, মামা-ভাগ্নে মিলিয়ে বদির ১০ জন লোকের নাম রয়েছে।

সন্ত্রাস ও দখলবাজি : অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ স্থলবন্দর, হাটবাজার, ঠিকাদারি, পরিবহন, পর্যটকবাহী জাহাজ, টার্মিনাল, জেটিসহ সীমান্ত চোরাচালান ব্যবসা পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন এমপি বদি। সঙ্গে রয়েছেন তার ছোট ভাই আবদুল আমিন। এখন আবদুল আমিনের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকনাফ বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। এমপির নিজস্ব বন্দর বলে খ্যাত অবৈধ কাইয়ুকখালী ঘাটের চিংড়ি মাছ, কাঠ, ফলমূল আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেন তার ভগ্নিপতি গিয়াস উদ্দীন ও ফুফাতো ভাই সৈয়দ আলম। এমপি তার প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমার থেকে আনা মালামাল অবৈধভাবে এ ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। এ বন্দর দিয়ে বিপুল চোরাই পণ্য মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

মারধরে পারদর্শী : এদিকে ‘অবাধ্যতার দায়ে’ বিভিন্ন সময় এমপি বদি নিজেই মারধর করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের একমাত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিন পর টেকনাফ উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোট কেন্দ্রে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে মারধর করেন বদি। এরপর তার হাতে প্রহূত হন টেকনাফের বন বিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান। সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ কেউ বাদ যাননি।

সর্বশেষ খবর